বাংলাদেশে সংযুক্তি ও অবকাঠােমার দেখভাল
June 6, 2015
উপমহাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপ্তি ও বিবর্তন
September 3, 2015

বাংলাদেশের যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থার রাজনীতিক – অর্থনীতি

 

ক্ষু দ্রাতিক্ষুদ্র সমাজগোষ্ঠী’র মাঝে যোগসূত্রতা গড়ে উঠার পরিণতিতে আজকের মানবসভ্যতার উদ্ভব। সেই যোগসূত্রতা সম্ভব হয়েছে যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থার ক্রমাগত অগ্রগতি’র ফলেই। তাই ক্ষুদ্র ভৌগলিক সীমারেখার মাঝেই হোক অথবা বিশ্বায়িত বৃহত্তর অঙ্গনেই হোক, নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের বা দেশের (বা সমাজের ) রাজনীতি-অর্থনীতি সেখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যদি সেই যোগাযোগ থেকে উদ্ভূত সংযুক্তি শাসকগোষ্ঠী’র জন্য খাজনা আদায়ের  সুযোগ এনে দেয়, রাজনীতি’র অঙ্গনের অনেক উঠানামা’র ব্যাখ্যা যোগাযোগ ব্যবস্থা’র গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণে পাওয়া যেতে পারে। এ’নিবন্ধে বিষয়গুলো আলোচনায় এনে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি’র সম্ভাব্য গতিপথ সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করবো। তথ্যের অসম্পূর্ণতার জন্য ব্যাখ্যা বা অনুসিদ্ধান্তে ঘাটতি থাকতে পারে, আশা করবোযে সুযোগ্য পাঠকেরা তা শুধরে নিবেন।

অর্থনীতি’র আঙ্গিকথেকেই আলোচনা তুলবো। আর্থিকসমৃদ্ধির মূলে আছে পুঁজির বিকাশ — তা প্রযুক্তি, উন্নত মানবসম্পদ, বা অন্য যেকোনও রূপেই আসুক না কেন। উভয় ব্যাক্তিও সামষ্টিক পর্যায়ে, উপযুক্ত বিনিয়োগ ঘটলেই পুঁজির বিকাশসম্ভব হয়। অনেক সময়আমরা ক্ষুদ্রাকার গণ্ডীর বিনিয়োগ ভাবনায় আবদ্ধ থেকে প্রকৃত বিনিয়োগের পূর্বশর্তের দিকগুলো ভুলতে বসি। উপযুক্ত যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা সেসব পূর্বশর্তের মাঝে সর্বাধিক গুরুত্ত্বপূর্ণ – এমনকি, কোন কোনক্ষেত্রে, যোগাযোগ ব্যবস্থাকে পূর্বশর্তের ও পূর্বশর্ত হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। যেমন, জ্বালানী পেতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানী তেল বা প্রাকৃতিক গ্যাসের পরিবহণ আবশ্যিক। অতীতে,  যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা উঠলে সাধারনত যাতায়াত-ব্যবস্থাকেই বুঝানো হতো; এবং সঙ্গতকারণে, প্রচলিত যাতায়াত মাধ্যমকে (যেমন, রাস্তা, রেল, নদীপথ ও আকাশপথ) ব্যবহার করেকাঁচামাল/পণ্য, উৎপাদিতদ্রব্য অথবা মানুষরূপী যাত্রী’র (ও শ্রমের) চলাচলকে ‘পরিবহণ’ বলে আখ্যায়িত করা হতো। তাই মানুষ ও পণ্যের ফারাক না টানলে, ধারনা পর্যায়ে, পরিবহনকে যাতায়াত ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য কার্যরূপ হিসেবে গণ্য করা হয়।

নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কারের সাথে সাথে যোগাযোগ-বিষয়ক আলোচনার ব্যাপ্তি বেড়েছে। এক পর্যায়ে যোগাযোগ ব্যবস্থায় ডাক ও তার অন্তর্ভুক্ত হলো। এবং, (অজানা কারণে) তথ্যকে যাতায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন রাখলেও, আজ তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার শুধুমাত্র তথ্য-প্রবাহে (তথ্যের যাতায়াতে)-ই সীমাবদ্ধ নয় —তা সকলপ্রকার যাতায়াতের ক্ষেত্রে এক অপরিহার্য অঙ্গ।  বিজ্ঞানের আবিষ্কার ও সেসবের প্রায়োগিক বিস্তৃতির সাথেসাথে যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রযুক্তি-প্রাপ্যতার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। তাই যাতায়াত-সম্পর্কিত যেকোন আলোচনায় সেসব প্রযুক্তিকে ধর্তব্যে আনা প্রয়োজন,যার আংশিকপ্রয়াস এ’নিবন্ধে নেয়া হয়েছে।

এ’নিবন্ধের আলোচনা একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমানাকে নিয়ে -যা প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ হলেও, একপর্যায়ে বঙ্গোপসাগরের উত্তরে অবস্থিত বৃহত্তর অববাহিকা’র প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। অর্থনীতিক দিকগুলোর প্রতি গুরুত্বদেয়া হয়েছে – বিশেষত সেসব উপাদান, যা ‘খাজনা’র (ইকনোমিক রেন্ট) পরিমাণনির্ধারনে মুখ্য ভূমিকা রাখে। উল্লেখ্য যে, কোথা ও অতিরিক্ত আয়ের সম্ভাবনা দেখা দিলে সেই খাজনার বণ্টন ও তা নিয়ে কাড়াকাড়ি (যা প্রায়শই মারামারিতে রূপ নেয়) সমাজ ও রাজনীতি’র অঙ্গনে প্রকাশ পায়। ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে দেখা যায়, বাণিজ্যপথের নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা ক্রুসেড-এর মত ধর্ম-যুদ্ধের ইন্ধন যুগিয়েছিল, এবং বাংলার উর্বর ভূমিতে খাজনা ভোগের আশায় সুদূর আফগান মুলুক থেকেও সৈন্য-সামন্তের আগমন ঘটেছিল। একইভাবে, আজকের অধিকতর বিশ্বায়িত শতাব্দীতে, বাংলাদেশে অতিরিক্ত আয় বা মুনাফালাভের (অর্থাৎ খাজনা প্রাপ্তির) সম্ভাবনা দেখা দিলে এখানকার বাজার ও সম্পদ নিয়ন্ত্রনের রাজনীতি কেবলমাত্র দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত এ-দল ও বি-দলের দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখাটা বড্ড একপেশে হবে। তবে তথ্যের অভাবে রাজনীতি’র আলোচনা এ’নিবন্ধে পরোক্ষভাবে উত্থাপন করা হয়েছে, যা মূলত অর্থনীতি পাঠ্যপুস্তকে উল্লেখিত ডুয়্যালিটি তত্ত্বের প্রয়োগমাত্র। ডুয়্যালিটি সম্পর্কে কেবল একটি মন্তব্য করবো — আমাদের মনেরমাঝে যে শার্লক হোমস বা ফেলুদা চরিত্রের গোয়েন্দা-মন লুকিয়ে রয়েছে, ঘটনার প্রকাশ্য রূপ দেখে সেই অনুসন্ধিৎসু মন তার নেপথ্যের চরিত্রগুলো ও তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনুসিদ্ধান্তে পৌছুতে চেষ্টা করে। একইভাবে, এ’নিবন্ধের শেষে, নতুন প্রকল্পের সম্ভাব্য যোগসূত্রতা দেখে আমরা নেপথ্যের বিভিন্ন চরিত্রের আর্থিক স্বার্থ ও তা সিদ্ধির জন্য রাজনীতি’র অঙ্গনে ঘটানো কর্মকান্ড অনুধাবনে সচেষ্ট হবো।

অর্থনীতি’র সঞ্চালনে যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে, (১) এক স্থানের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করে অন্য স্থানে কাঁচামাল হিসেবে সেসবের ব্যবহার বৃদ্ধিসম্ভব হয় (কাঁচামাল আমদানি-রপ্তানি), (২) এক স্থানের উৎপাদিত দ্রব্য অন্য স্থানে সরবরাহ অধিকতর কম খরচে/সময়ে সম্ভব হয় (দ্রব্য ও যন্ত্রপাতি আমদানি ও রপ্তানি), (৩) স্বল্প খরচে এবং দ্রুততার সাথে বিভিন্ন স্থানের মাঝে শ্রম-প্রবাহ সম্ভবহয় (অভিবাসন বা শ্রম রপ্তানী-আমদানী)। তথ্যপ্রযুক্তি ও অর্থব্যবস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করলে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের অতিরিক্ত তিনটি ফল উল্লেখ করা যেতে পারে — (৪) উন্নত তথ্যপ্রবাহ আন্তর্জাতিক অর্থ-প্রবাহকে সহজকরে এবং পূর্বোল্লেখিত তিনটি ধারাকে অধিকতর সঞ্চালিত করে, (৫) অর্থ-ব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ এনে দেশীয় পর্যায়ে যেমন সম্পদের উপর মালিকানাপ্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়, তেমনি,বিশ্বায়িতঅর্থ-ব্যবস্থার উপর উন্নত দেশগুলোর অধিকতর নিয়ন্ত্রণ আন্তঃদেশীয় সম্পদ ‘পাচার’কে সহজ করে ভৌগলিক বৈষম্যের বৃদ্ধি ঘটায় (লক্ষণীয় যে, এ’বিষয়টির সাথে তথ্যপ্রযুক্তি ও তথ্যপ্রবাহের উপর নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও জড়িত), এবং (৬) যোগাযোগ বৃদ্ধির ফলে যেমন প্রযুক্তি জ্ঞানের প্রসার ঘটেএবং দ্রব্য ও শ্রম বাজারগুলোতে সংযুক্তি বৃদ্ধি পায়, একইসাথে, (বিশেষত) ভার্চুয়াল যোগাযোগ বৃদ্ধির ফলে, ব্যাক্তি-চাহিদার ধরন ব্যাপকভাবে প্রভাবান্বিত হয়। এজাতীয় প্রভাব সাধারণত একমুখী হওয়ায় উন্নত বাজারে তৈরি পণ্যের বিশ্বব্যাপী বাজার সম্প্রসারণে তা যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। একই ভার্চুয়াল সংযুক্তি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের আপাতঃ সমধর্মী সমাজকে সংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভাবাদর্শের অঙ্গনে বহুধাবিভক্ত করবার ক্ষমতাও রাখে। দৈনন্দিন ঘটনার সাথে এ বিষয়গুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিধায় এসবের ব্যাখ্যা দিচ্ছি না।

বাংলাদেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের সাথে আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক যোগসূত্রতা’র প্রভাব স্বল্পমেয়াদে অর্থনীতি ও বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধার বিচারে সাধারণত ইতিবাচিক গণ্যকরা হয়। অর্থাৎ, ধারনা করা হয় যে এ ‘যোগসূত্রতা, বিনিময় মূল্যের মাপকাঠিতে, দেশজ উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি এনেছে বা আনবে। যেমন, যমুনা সেতু নির্মানের ফলে উত্তরবঙ্গ এবং ঢাকা উভয়েই লাভবান হয়েছে; দ্রুত যাতায়াত ব্যবস্থার জন্য সেখানকার শ্রমিক স্বাচ্ছন্দ্যে চট্টগ্রামে অধিক আয়ের কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়; মোবাইল ব্যাংকিং বাণিজ্যিক লেনদেনকে যেমন উপকৃত করেছে তেমনি দেশের ভিতরে ও বাইরে রেমিটেন্স প্রবাহকে সহজ করেছে, ইত্যাদি। এসব কিছুই এ-অঞ্চলের নাগরিকদের জন্য অতিরিক্ত আয়/সাশ্রয় এনেছে, এবং যারা রাজনৈতিক অঙ্গনে বা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের মাধ্যমে তাদের “শাসন”করে, সেইসব ব্যাক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য বৈধ এবং অবৈধ পথে নাগরিকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত খাজনা (বা টোল) আদায়ের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে যোগাযোগ-এর ঋণাত্মক প্রভাবও রয়েছে। অনস্বীকার্য যে, কোন কোন জনগোষ্ঠী উন্নত যোগাযোগের কারণে কর্মসংস্থান হারায় অথবা অর্থ-চালিত বাজারের কাছে হার মেনে ভিটেমাটি থেকে বহিষ্কৃত হয়। সহজেই দৃশ্যমান একটি উদহারণ হলো, সেতু চালু হবার পর পুরনো ফেরী পারাপার এবং ফেরিঘাট সংশ্লিষ্ট কর্মসংস্থানের বিলুপ্তি। অথবা, নতুন যোগাযোগ-সংযুক্তি সম্পর্কে যাদের কাছে পূর্ব-তথ্য থাকে, তাঁরা অর্থ ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আদি বসবাসকারীদের ভিটেচ্যুত করে জমির দাম-বৃদ্ধি থেকে উদ্ভূত লাভের অধিকাংশটাই পকেটস্থ করে। এমনকি স্থানীয় বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে সেসব পণ্য অনেকের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়, এবং স্থানীয় মজুরী বৃদ্ধির ফলে (অথবা শ্রম রপ্তানি বা অভিবাসন-সূত্রে মেধা-পাচারের ফলে উদ্ভূত দক্ষ শ্রমের অভাবে) উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়, যা স্থানীয় বিনিয়োগে ঋণাত্মক প্রভাব ফেলে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সুবিধা প্রাপ্তির পরিমাণ বেশী গণ্যকরায় “ক্ষুদ্রস্বার্থে”র জলাঞ্জলি’র এমন কাহিনী দেশের অভ্যন্তরে বিবিধ (যোগাযোগ ও পরিবহণ) উন্নয়ন প্রকল্পে হরহামেশাই দেখা যায়, এবং নীতি পর্যায়ে তা স্বাভাবিক গণ্য করা হয়। একইভাবে, যখন একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের ভৌত অবকাঠামোতে বিনিয়োগ বা অন্যান্য ব্যবস্থাপনায় আঞ্চলিক বা কোন আন্তর্জাতিক স্বার্থ প্রাধান্য পায়, সেসব ক্ষেত্রে, দেশীয়স্বার্থ অবহেলিত হবার সম্ভাবনা থেকেই যায়।[1] দেশের অভ্যন্তরে অবকাঠামোতে নতুন বিনিয়োগ উদ্যোগে ভিটেচ্যুত বা কর্মচ্যুত জনগোষ্ঠীকে অনুদানের মাধ্যমে সাময়িক সামাজিক নিরাপত্তা (সোশ্যাল সেফটি নেট কর্মসূচী) বিধানের যেমন ব্যবস্থা রয়েছে, আন্তর্জাতিক পরিসরে একইভাবে ‘অনুদান’ দেয়ার চল রয়েছে। উল্লেখ্য যে, প্রকল্পের নেপথ্যের স্বার্থ যখন দেশের সীমানা পেড়িয়ে যায়, এ দুটোই তখন একই সূত্রে গাঁথা থাকে। কাগজে-কলমে অবশ্যসিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় যৌক্তিকতার মাপকাঠি হিসেবে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের জন-বসতির নীট লাভ বিবেচনায় নেয়া হয়, যদিও লাভ ক্ষতি নিরূপণের চোরাগলিতে প্রান্তিকীকরনের ধারা রোধের দৃষ্টান্ত বিরল।

সময়ের বিচারে, যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থার রাজনীতিক-অর্থনীতি’র ন্যূনতম তিনটি পর্ব রয়েছে। শুরুতে সাধারণত সরকারী বিনিয়োগ মুখ্য ভূমিকায় থাকে, যদিও অতীতে (উপনিবেশিক আমলে) রেলখাতে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাক্তি-মালিকানাধীন উদ্যোগ মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল। নদী খননে এবং রাস্তাঘাট, সেতু, রেলপথ, পাইপলাইন, ইত্যাদি নির্মান কাজে অর্থায়ন ও ঠিকাদার নিয়োগ ও তাদের কাছ থেকে কাজ বুঝে নেয়া — এসবই প্রথম পর্বের কর্মকান্ড। নির্মিত অবকাঠামোর তত্ত্ববধায়ন ও রক্ষানাবেক্ষণ এবং তা ব্যবহারের স্বত্ব বিলিবন্টন (অথবা ব্যবহারের নীতিমালা প্রণয়ন) অনেক ক্ষেত্রেই অবকাঠামোতে বিনিয়োগ সিদ্ধান্তকালে স্থির করা হয়। নতুন আঙ্গিকে সাজানো যোগাযোগ ব্যবস্থার (এবং আবশ্যিক অবকাঠামোর) সুযোগ নিয়ে দ্বিতীয় পর্বে আসে পণ্য বা সেবা খাতের বিনিয়োগকারীরা – দেশী-বিদেশী-যৌথ, যে রঙেই হোক না কেন। আগেই উল্লেখ করেছি, সে বিনিয়োগের উদ্দেশ্য নানাবিধ হতে পারে – নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের সম্পদ আহরণ, স্থানীয় শ্রম ও অন্যান্য সম্পদ ব্যবহার করে দ্রব্যউৎপাদন ও সেবা-সরবরাহ, আমদানি করাপণ্যের বাজারজাত, রপ্তানীযোগ্য পণ্যের পরিবহণ, অথবা ট্রানজিট বা ট্রানশিপমেন্ট ব্যবস্থায় ভিনদেশের পণ্য-বাণিজ্য বা কাঁচামাল পরিবহণ। এই দ্বিতীয় পর্বের বিনিয়োগ-সফলতার উপরেই নির্ভর করছে প্রথম পর্বের (অবকাঠামোতে) বিনিয়োগের আর্থিক লাভক্ষতি; এবং সে’কারনে, দ্বিতীয় পর্বের প্রতিদ্বন্দ্বীতা এবং বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আশা-আকাংখা অনেক সময়েই যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন বিনিয়োগের রূপরেখাকে প্রভাবান্বিত করে। এই দুই পর্বের পথ-পরিক্রমায় বিভিন্ন স্বার্থের ঘাত-প্রতিঘাতে নির্দিষ্ট কোনও ভূখন্ডে সমাজ ও রাষ্ট্র যেমন সুদৃঢ় হবার সম্ভাবনা রাখে, তেমনি রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূর্বলতা বা “বিজাতীয়” স্বার্থের কারণে সর্বস্তরের স্বকীয় প্রতিষ্ঠানে ভঙ্গুরতা বেগবান হতে পারে। শেষোক্ত ব্যর্থতার প্রকাশ ন্যুনতম দুভাবে ঘটতে পারে -সেখানকার সমাজ-অর্থনীতি ও রাষ্ট্রের স্বকীয়তা বৃহত্তর স্বত্বায় বিলীন হয়ে একধরনের (পর-নির্ভর) স্থিতিশীলতায় পৌঁছানো, অথবা, সুদৃঢ় মালিকানার অভাবে সেখানে দীর্ঘকালীন অস্থিতিশীলতার অশনিসংকেত! এসব কিছুকে নিয়েই তৃতীয় পর্বের রাজনীতিক-অর্থনীতি, যার প্রকাশ সময়ের মাপকাঠিতে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।

**

ফেরা যাক বাংলাদেশ ও বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলে। শুরুতেই কয়েকটি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্ত্বপূর্ণ যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সেসবের বিবর্তন সম্পর্কে  উল্লেখ করবো। শেষ করবো যোগাযোগ খাতের প্রকল্প নির্বাচন ও বাস্তবায়নে সমকালীন ঘটনাপ্রবাহ এবং সে-সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক-অর্থনীতি’র আলোচনা দিয়ে।

আজকাল প্রাচ্যের সাথে যোগাযোগ আলোচনায় প্রায়শই সিল্করুটের প্রসঙ্গ উঠে। সিল্করুটের নির্দিষ্ট পথটি দিয়ে পণ্য বাণিজ্যে চীনা সিল্কের আধিক্য থাকায় এই নামকরণ। মূল সিল্করুটটি কিন্তু চীনের সাথে ভূমধ্যসাগর উপকূলকে সংযুক্ত করেছিল, এবং তা হিমালয় পর্বতমালার উত্তরে অবস্থিত। পরবর্তীতে অবশ্য নানা পথ বিভিন্ন পণ্য নিয়ে এই মুল পথটির সাথে যুক্ত হয়েছে, যার একটি (কটন  বা তূলা রুট) [2] উপনিবেশিক (অবিভক্ত) ভারতে কলকাতার অদূরে ক্যানিং বন্দর থেকে উত্তর-পশ্চিমেদীর্ঘ পথপরিক্রমা করে (বর্তমান) পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চল ও আফগানিস্তান হয়ে সিল্করুটের সাথে যুক্ত হয়। লক্ষণীয় যে, এই পথে শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়াও অন্যান্য দক্ষিন-পূর্ব এশীয় দেশ থেকে সংগৃহীত মশলা ও ধূপদ্রব্য বহু শতাব্দী জুড়ে ইউরোপের পথে পাড়ি দিত। এরও বহু পূর্বে, মৌর্য রাজাদের সময়ে, গঙ্গার পাড়েগড়ে উঠা জনপদগুলোকে সংযুক্ত করে যে ‘উত্তরপথ’ তৈরি হয়েছিল, তা শেরশাহের সংক্ষিপ্ত জীবদ্দশায় ‘গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক’ রাস্তা হিসেবে পুনঃনির্মিত হয়। হিমালয়ের দক্ষিণাঞ্চলের এই পথটি উত্তর ভারতে সাম্রাজ্য গঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখলেও তা মুখ্যত বাণিজ্যের কারণে নির্মিত হয়েছিল বলে শোনা যায়না। পক্ষান্তরে, ১৮৭০ সনের ব্রিটিশ-অধীনস্থ ভারতবর্ষে, ক্যানিং থেকে শুরু হয়ে এলাহাবাদ-দিল্লী-লাহোর পর্যন্ত বিস্তৃত রেলপথটি নির্মিত হয়েছিল মূলত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে। সে সময়ে কলকাতা থেকে পূর্বে শুধুমাত্র একটি লাইন ফরিদপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল — বর্তমানের মৈত্রী এক্সপ্রেস রুটের দর্শনা-গেদে সেই আদি লাইনেই পড়ে। এটাও সর্বজনবিদিত যে নীল (ইন্ডিগো), পাট, কার্পাস তুলো, কয়লা ওঅন্যান্য খনিজ-পদার্থের আকর্ষন, সেসময়কার যাতায়াত ব্যবস্থার বিন্যাস নির্ধারন করেছিল। কথিত আছে যে, ১৮৪৬ সনে যুক্তরাষ্ট্রে তূলা উৎপাদনে আকস্মিক বিপর্যয়ঘটলে যুক্তরাজ্য (ব্রিটেইন) ও ইউরোপীয় দেশগুলো তূলার বিকল্প উৎস খুঁজতে তৎপর হয় এবংতার ফলশ্রুতিতেই ভারতে রেল লাইন বিস্তারে উপনিবেশিক ইংরেজদের প্রথম উদ্যোগ।

আগেই বলেছি, ১৮৭০ সনে কলকাতা’র পূর্বে কেবলমাত্র ফরিদপুর অবধি একটি লাইনের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। ১৯০৯ সনের মাঝে পূর্ব-ভারতীয় রেল-নেটওয়ার্ক অধিক বিস্তৃত হলেও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে বর্তমান ভারতের উত্তরাঞ্চল ও পশ্চিমের সরাসরি কোনও যোগাযোগ ছিল না। তবে ১৯৩১ সনের মাঝে শিলিগুড়ি-দার্জিলিং দিয়ে (যা‘চিকেন নেক’ নামে পরিচিত) এই যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩১ সনের রেল-মানচিত্রে পূর্বমুখী বিস্তৃতি নিম্নরূপছিলঃ কলকাতা-ফরিদপুর রুটের সাথে হার্ডিঞ্জ সেতু পেড়িয়ে উত্তরমুখী পার্বতীপুর দিয়ে রেলপথ; সেই পথেরএকটি ভাঙ্গা অংশ জগন্নাথগঞ্জের ফেরী পাড় হয়ে ময়মনসিং হয়ে ঢাকার সাথে সংযুক্ত হয়; তারও আগে সিরাজগঞ্জে ফেরী পাড় হয়ে ঢাকার সাথে সংযুক্তি আনার ভিন্ন একটি লাইন ছিল; ঢাকা থেকে আখাউড়া হয়ে দক্ষিণে লাকসাম, মাইজদী ও চট্টগ্রাম পথে তিনটি ভিন্ন লাইন; আখাউড়া থেকে আসামের বদরপুর অবধি লাইনটি অরুণাচল প্রদেশপর্যন্ত বর্ধিত হয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে চট্টগ্রাম বন্দরকে যুক্ত করেছিল; এবং বদরপুর থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর কূল ঘেঁষে দিনাজপুর-বিহার সীমান্তে পশ্চিমমুখী লাইনের সাথে যুক্ত হয়ে উত্তর ও পশ্চিম ভারতকে অধিক খনিজসম্পদ প্রাপ্তির সুযোগ করে দেয়। লক্ষণীয় যে ১৯০৯ সন (বা তার কিছু পর) অবধি অরুণাচল প্রদেশ থেকে আসামের বদরপুর হয়ে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে সম্পদ বিদেশে নেয়া হতো; এবং তার বাইরে, পূর্ব ভারতের পন্য-চলাচল মূলত কলকাতা-কেন্দ্রিক হতো। ১৯৩১ সনেস্পষ্টতই, সরাসরি রেলসংযোগ প্রতিষ্ঠা হওয়ায় পণ্যপ্রবাহে উত্তর ও পশ্চিম ভারত-মুখীতাবৃদ্ধি পায়। কিছুটা কাকতলীয় মনে হতে পারে, তবে লক্ষণীয় যে ১৯৩০ দশকের শুরুতেই ভারতীয় রাজনীতি’র কেন্দ্রে অবস্থিত কংগ্রেস-এর নেতৃত্ব বাংলার হাত থেকে এলাহাবাদ ও পশ্চিম ভারতীয় পুজি’র স্বার্থরক্ষাকারী (প্রতিনিধি)-দের হাতে চলে যায়!

তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে রেল ও নদীপথই ছিল যাতায়াতের মূল মাধ্যম। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে বিভিন্ন কারণে রেলপথে সেবা’র মানে অধোগতি ঘটে, নদীপথের ব্যাপ্তি সংকুচিত হয়ে আসে, এবং ক্রমাগত হারে সড়ক পথের বিস্তৃতি ঘটে। ষাটের ও সত্তুরের দশকে পাবলিক ওয়ার্ক্স কর্মসূচী (যা পরবর্তীতে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীতে নামান্তারিত হয়) ও ‘কেয়ার’-এর মাটির রাস্তা দীর্ঘদিন ধীর গতিতে গ্রামীণ জনপদকে সংযুক্ত করছিল। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠনে ঢাকা-কেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা সুদৃঢ় হতে দেখা যায়। আরও পরে, বিশেষত আশিরদশকে, সড়ক নির্মানে ও সড়ক-উন্নয়নে ব্যাপক সরকারী বিনিয়োগ ঘটে, যা ক্রমান্বয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাথে ঢাকার যোগাযোগ বৃদ্ধি করে। ফলশ্রুতিতে, সড়ক-পরিবহনে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়; গাড়ী,বাস ও বিভিন্ন আকারের ট্রাকের চাহিদা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে; এবং কেবল ঢাকা-কেন্দ্রিক উন্নয়নের ফলে, কর্মসংস্থানের সন্ধানে আসা মানুষের ভিড়ে সুস্থ নগরায়ন বিপর্যস্ত হতে শুরু করে। সংযুক্তি (কানেক্টিভিটি) বৃদ্ধির ফলে নিঃসন্দেহে স্থানীয় পণ্যের উৎপাদক, শ্রমের বিক্রেতা ও শহুরে ক্রেতা সাধারন উপকৃত হয়েছে, যদিও এক-শহরকেন্দ্রিক বিন্যাসের কারণে একই অভ্যন্তরীণ সংযুক্তি পরবর্তীতে অগ্রগতির হার রুদ্ধকরেছে। অধিকন্তু, সেই প্রাপ্তির একটি বৃহদাংশের ভাগীদার হয়েছে পরিবহণে ব্যবহৃত গাড়ী, বাস ও ট্রাক বিক্রেতা/আমদানীকারক/প্রস্তুতকারক এবং সেসবে ব্যবহৃত জ্বালানীর সরবরাহকারীরা। সম্ভবত সেকারণেই রাস্তাঘাট ও সেতু নির্মানে জাপানী ঋণের আধিক্য দেখা গিয়েছে, যা অনেক সময় বিশ্বব্যাংকের মত বহুজাতিক সংস্থার মাধ্যমেও এসেছে। একই উদ্দেশ্যে ভারতীয় ঋণের আবির্ভাব গত এক দশকে দৃশ্যমান, যদিও সে’দেশে প্রস্তুত অটোরিক্সা, বাস ও ট্রাকের আধিক্য বাংলাদেশের রাস্তায় বহুদিন যাবত চলছে। ধীরে হলেও, অতি সম্প্রতি চীনা বাসের আমদানি নিয়ে অনেক গুঞ্জরন শোনা গেছে; যদিও সেতু ওবন্দর নির্মানে চীনা ঋণের আগ্রহ অধিকতর।

সনাতনী যোগাযোগ ব্যবস্থার আলোচনায় গ্রিড-লাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ তুলনামূলকভাবে কম নজর পায়, যদিও বিগত বছরগুলোতে (প্রায় দেড়দশক জুড়ে) আঞ্চলিক সংযুক্তির আলোচনায় এ বিষয় দুটো প্রাধান্য পেয়েছে। ২০১৩ সন থেকে পশ্চিম বাংলার বহরমপুরহয়ে ভেড়ামারা সংযোগস্থল দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ আমদানি করছে, যা ঋণদানকারী সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এর বক্তব্য অনুযায়ী ৫০০ মেগাওয়াট ধারণক্ষমতা থেকে ১০০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হবার কথা। বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্যে জানা যায় যে, এই প্রাথমিক সংযুক্তি পদ্মা সেতু পেড়িয়ে পূর্বাঞ্চলের আসামের শিলচর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। তবে এপথের মূল লাইনটি সীমান্ত পেরুবে কুমিল্লা দিয়ে; এবং ২০১৫ সনের ৩১ শে মার্চের একনেক বৈঠকে কুমিল্লা-ত্রিপুরা বিদ্যুৎ সংযুক্তির প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকার অনুমোদন দিয়েছে। নেপাল ও ভুটানের সাথে ভারতের এজাতীয় লেনদেন-এর ইতিহাস দেখে মনে হয় যে, আগামীতে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ তৈরি শুরু হলে (সোয়াপ, অর্থাৎ দ্রব্য/সেবা বিনিময়-এর আওতায়) একই পথে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে ভারতে বিদ্যুৎ রপ্তানি হবে। অর্থাৎ আজকের কেনা বিদ্যুৎ আগামীতে রপ্তানির নামে ফেরত দিতে হবে, এবং চুক্তির বিশদ শর্তাদি ঘাঁটলে হয়তো দেখা যাবে, ভবিষ্যতের সেই বিনিময় অতি স্বল্প দামে করা হবে। ক’দিন আগে ভারতের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত পশ্চিম বাংলার দক্ষিণে অবস্থিত সাগর দ্বীপে নতুন সমুদ্র বন্দর-এর খবর ও নৌঘাঁটি স্থাপনের কানাঘুষোটি যদি সত্যি হয়, সে নির্মানের চাহিদা মেটাতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ বিপরীতমুখী হওয়া খুবই সম্ভব।[3]

প্রাকৃতিক গ্যাস জ্বালানী হিসেবে পরিচিত, কিন্তু পাইপলাইন বা অন্য কোনভাবে তার পরিবহণ যাতায়াত ব্যবস্থারই অঙ্গ। গ্যাসপাইপ লাইনের তথ্যাদি সাধারণত রহস্যাবৃত থাকে —এবং ঘটনা-পরবর্তী তথ্যই আমরা পেয়ে থাকি। ২০১২ সনে জার্নাল অফ এনার্জী সিকিউরিটি-তে প্রকাশিত কেশভ চন্দ্রের লেখা একটি নিবন্ধ পড়ছিলাম – “দ্য পাইপলাইন দ্যাট ওয়াজন্টঃ মিয়ানমার, বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া ন্যাচারাল গ্যাস পাইপলাইন”। নিবন্ধকার উল্লেখ করেন যে, মিয়ানমার-এর  সিতওয়ে (রাখাইন প্রদেশের রাজধানী) থেকে ভারতে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের ভূমি দিয়ে পাইপলাইন নির্মান করার প্রস্তাব ১৯৯৭ সনে বাংলাদেশে তোলা হয়। নিদারুণ পরিতাপের বিষয় ,সম্ভাব্য চুক্তির বিবিধ দিক সম্পর্কে স্বচ্ছতা না রেখে ১৯৯৯-২০০০ এর দিকে আন্তর্জাতিক তেল-কোম্পানী’র কেউ কেউ অবিশ্বাস্য পরিমাণ গ্যাস মজুদের ধুয়ো তুলে এবং বাংলাদেশে উত্তোলিত গ্যাস রপ্তানির অজুহাতে সেই পাইপলাইন নির্মানের যাবতীয় খরচ বাংলাদেশের উপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ-ভারত সমঝোতায় পৌছুতে ব্যর্থ হলে এবং সেই বিলম্বকালে চীনা বিনিয়োগে মিয়ানমার-এর রাখাইন প্রদেশের শওয়ে উপকূল থেকে চীন-এর কুনমিং অবধি প্রাকৃতিক গ্যাস (ও জ্বালানী তেল)-এর পাইপলাইন নির্মান হওয়ায়, বাংলাদেশ দিয়ে সিতওয়ে’র গ্যাসপ্রবাহের সম্ভাবনা এখন নেই বললেই চলে। ‘নেট’ ঘাঁটলে জানা যায় যে, বাংলাদেশের সাথে সমঝোতায় পৌছুতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশকে এড়িয়ে দুটো ভিন্ন পথে মিয়ানমার-এর গ্যাস ভারতে নেয়ার আশা (ভারতীয় মহলে) বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যক্ত করা হয়েছিল। প্রথমটি বঙ্গোপসাগরের তলদেশ দিয়ে, এবং দ্বিতীয়টি “কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প” নামে কথিত, যা সিতওয়ে থেকে শুরু হয়ে কালাদান নদী বরাবর উত্তরমুখী যেয়ে মিজোরাম-এর লাংতলাই জেলা দিয়ে ভারতে প্রবেশকরে পাটনা, লক্ষ্ণৌ হয়ে পশ্চিম ভারতের পথে পাড়ি জমাবে। কিন্তু সে সবসম্ভাবনা আজ মৃতপ্রায় — গত জানুয়ারি (২০১৫) থেকে শুধু সিতওয়ে থেকে গ্যাসই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানী তেল শওয়ে’র টার্মিনাল হয়ে দীর্ঘ পাইপলাইন দিয়ে কুনমিং-এ পৌছুতে শুরু করেছে।[4] এবং সে কারণেই সম্ভবত, সনাতনী পশ্চিমা স্বার্থের সাথে একাত্ম প্রকাশ করে (পশ্চিমা) ভারতকে ‘কটন রুট’ রূপরেখার আওতায় নতুনভাবে পরিকল্পনা করতে দেখা যাচ্ছে[5]। এবং আগামী কোন একদিন মিয়ানমারের গ্যাসে ভাগ বসাতে পারলে উল্লেখিত কালাদান প্রকল্প গতি পেতে পারে, যে আশা বিভিন্ন নিবন্ধে মাঝে মধ্যেব্যক্ত করা হয়।[6]

পরিশেষে,  যোগাযোগ ব্যবস্থায় ইন্টারনেট ও মোবাইলের সংযোজন-এর গুরুত্ব প্রকাশের লক্ষে কিছু বর্ণনা দিব। শুরুতেই বলা প্রয়োজন যে সেবাখাতে এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণে এ-প্রযুক্তির অপরিসীম অবদান রয়েছে। এর অন্তর্ভুক্তি যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা এনে দেয়, যার সাথে আর্থিক লাভক্ষতির বাইরে ও নিরাপত্তা ও তথ্য-নির্ভর অন্যান্য বাজার নিয়ন্ত্রণের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অযৌক্তিক শোনালেও সত্য যে, স্যাটেলাইট এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্যপ্রবাহের উপর মুষ্টিকয়েক-এর নিয়ন্ত্রণ পাশের বাড়ীর সাথে ফোনালাপ-এর খরচ বহুকাল বেশী রেখেছে, অথচ বাংলাদেশে বসে সুদূর আমেরিকাতে ফোন করতে অতি সামান্যই খরচ হতো। মোটাদাগে বললে, অবকাঠামোর ক্ষেত্রে, তথ্যপ্রবাহের দুটো মূল মাধ্যম রয়েছে – স্যাটেলাইট পথে ও ভূপৃষ্ঠে বা সমুদ্রতল দিয়ে ক্যাবল (তার সংযোগ)। এছাড়া, ভূপৃষ্ঠের সংযোগে সীমিত বেষ্টনীতে তার-বিহীন রেডিও তরঙ্গের ব্যবহার হয়। গ্রাহকপর্যায়ে আমরা যে আই,সি,টি পরিসেবা পেয়ে থাকি তার উপাদান (তথ্য) যদি দূর-দূরান্ত পেরুতে স্যাটেলাইট বা সাবমেরিন ক্যাবল ব্যবহার করে, স্থানীয় পর্যায়ে তা নির্দিষ্ট চক্রকেন্দ্র (হাব) থেকে আই,এস,পি, অথবা মোবাইল অপারেটর-এর সহায়তায় তার বা রেডিও তরঙ্গ (মোডেম সংযোগ) মারফত আমাদেরকাছে পৌঁছায়। চিরচারিত যাতায়াত পথের সংযুক্তি বা এক স্থান থেকে অন্য স্থানের প্রবেশদ্বার বহুলাংশে ভৌগলিক অবস্থান দ্বারা পূর্ব-নির্ধারিত। কিন্তু তথ্য-যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়— নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ ও প্রোগ্রামিং-এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট প্রবেশদ্বার (গেটওয়ে) দিয়ে সকল তথ্যের প্রবাহ নিশ্চিত করা সম্ভব; এবং সে প্রবেশদ্বার নিয়ন্ত্রকের পছন্দমত নির্বাচিত হতে পারে এবং তা সদা-পরিবর্তন করাও সম্ভব। তাই, বাণিজ্যে ব্যবহৃত সমুদ্রপথ বা স্থলপথ নিয়ন্ত্রণ করে খাজনা আদায়ের বাসনা যেমন অনেক ঐতিহাসিক যুদ্ধের (এমনকি ক্রুসেড নামক ধর্ম-যুদ্ধের) সূত্রপাত ঘটিয়েছিল, আধুনিক তথ্যপ্রবাহের বাজার দখলের প্রতিযোগিতা সে’তুলনায় কোনও অংশেই কম গুরুত্ত্বপূর্ণ নয়। প্রতিদ্বন্দ্বী’র নেটওয়ার্ক-কে বিপর্যস্ত করে বিস্তৃত জনগোষ্টীকে নিজের নেটওয়ার্কের আওতায় আনা এই যুদ্ধের মুখ্য উদ্দেশ্য, যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষে বাজার-বহির্ভূত শক্তির আশ্রয় নেয়। স্যাটেলাইট-এর সম্ভাব্য কক্ষপথ দখলী যেমন বাস্তব, তেমনি সাবমেরিন ক্যাবল (SEA-ME-WE 5 অথবা AAE-1) বা স্থল-ভিত্তিক ক্যাবল-সংযোগের চক্রকেন্দ্রগুলোর (হাব-এর) উপর নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতা প্রায়শই দৃশ্যমান। বাংলাদেশ দীর্ঘ অপেক্ষার পর SEA-ME-WE এর মাধ্যমে সাবমেরিন ক্যাবল সংযুক্তি বেছে নেয়, এবং মাত্র ক’দিন আগে (দ্বিতীয় ক্যাবল) কুয়াকাটাদিয়ে SEA-ME-WE 5 সংযুক্তির অনুমোদনকালে, এদেশের কর্তৃপক্ষ চীনা নিয়ন্ত্রিত AAE-1 এর সংযুক্তি নেয়া থেকে বিরত থাকে। আরও উল্লেখ্য যে, স্যাটেলাইট প্রেরিত তথ্য ভূপৃষ্ঠের নির্দিষ্ট কিছুপ্রেরণ/গ্রাহক-কেন্দ্রেরমাধ্যমে ভূপৃষ্ঠের অন্যান্য স্থানে বিতরিত হয়। ই-মেইলেরক্ষেত্রে বর্তমান বিতরণ ব্যবস্থায় এধরনের কোনও চক্রকেন্দ্রের অবস্থান বাংলাদেশেনেই, এবং শোনা যায় যে, স্বল্পমূল্যের বিকল্প চীনা প্রস্তাবনা নাকচ করে ভারতের দিল্লীকে চক্রকেন্দ্র হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ যতদিন না নিজস্ব স্যাটেলাইটচালু হচ্ছে অথবা আন্তর্জাতিক স্যাটেলাইট ব্যবস্থা থেকে সরাসরি সংযোগ স্থাপন সম্ভব হচ্ছে, এ দেশের তথ্যের আদান-প্রদান দিল্লী’র গেটওয়ে (এবং সম্ভাব্য নজরদারী) পেরুতে হবে। অবশ্য ভূপৃষ্ঠের একটি প্রবেশদ্বারের উপরেও অন্য প্রবেশদ্বার রয়েছে, এবং প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা ও পর-নির্ভর বাংলাদেশের পক্ষে নিকট ভবিষ্যতে তা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয় ভাবাটাই স্বাভাবিক।

ইন্টারনেটের প্রবেশদ্বার দখলী’র বাণিজ্যিক তাৎপর্য আজকের বাজারে অভাবনীয়, এবং অর্থনীতিক স্বত্ত্বার (এবং স্বকীয়তার) বিবর্তনে তার গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ‘সেলবাজার ডটকম’ থেকে’এখানেই ডট কম’-এ উত্তরণ এক ধরনের উদহারণ, যা কোন কোনখাতে জাতীয় গণ্ডীতে আবদ্ধ স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের বিলুপ্তির সংকেত দেয়। সংস্কৃতির বাণিজ্যকরন সম্পর্কে আজ কারো দ্বিধা থাকা উচিত নয়, বিশেষত ক্যাবল টেলিভিশন প্রচারণায় বিধিহীনতা ও বিধি-প্রয়োগের দূর্বলতা যেমন তথ্য-বিকার প্রশ্রয় দিচ্ছে, তেমনি বিজ্ঞাপনের দ্বারা দ্রব্য ও সেবাখাতের বাণিজ্যকেও স্বদেশ-বিমুখ করে তুলছে। অনস্বীকার্য যে, গ্রাহকদের পছন্দ ও বাজারে ভালো-মন্দের প্রাপ্যতা-সংক্রান্ত তথ্য, চক্রকেন্দ্র নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে অনেকাংশেই প্রভাবান্বিতকরা সম্ভব। শুধু তাই নয়, কোন একদিন আপনার স্মার্ট ফোনে ‘ওয়েদার ডট কম’-এ ঢাকা’র আবহাওয়ার খোঁজ নিতে যেয়ে আপনি যদি আপনার এলাকাকে ‘ব্রাহ্মণকিট্টা’ নামে চিহ্নিতদেখেন, অবশ্যই প্রশ্ন জাগবে, এটা কি আই,এস,পি’র কাজ, না কি আর ওসুদূরে অবস্থিত কোন তথ্য নিয়ন্ত্রক এ খেলায় রত! আজকাল তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় উৎপাদক ও সরবরাহকারীদের বেমালুম অদৃশ্য করে বিদেশী দ্রব্য ও সেবাকে আকর্ষনীয় করে তোলা সম্ভব। ইন্টারনেটে এলোপাথাড়ি দ্রব্যের নাম-ভিত্তিক অনুসন্ধান করলেই পাঠকরা উপরের মন্তব্য যাচাই করতে পারবেন। মোটকথা, যে কোন স্বত্ত্বার স্বকীয়তা তার অভ্যন্তরের মনন প্রক্রিয়ার অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল – এবং রাষ্ট্র ও সমাজের স্বত্ত্বা’র স্বাধীন অবস্থানের জন্য তথ্যপ্রবাহকে বিজাতীয় স্বার্থ থেকে মুক্ত রাখা প্রয়োজন। একইসাথে মনে রাখা জরুরী যে, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থায় আমরা শুধু তথ্য পাইনা, একই পথ দিয়ে আমরা নিজেদের ও পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে অনেক তথ্য অদৃশ্য গন্তব্যে প্রতিনিয়ত পাঠাচ্ছি, যা আমাদেরকে বাইরের জগতের অজানা শক্তির সহজ ক্রীড়নক করতে পারে!

**

সত্তুরের দশক জুড়ে এবং আশির দশকের গোড়া অব্দি একটির পর একটি রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের নেপথ্যের কাহিনী নিষিদ্ধনগরীর মত আজো আমাদের মনকে টানে। তবে, স্মরণ করা যেতে পারে, ষাটের দশক থেকেই তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তানে গ্যাস উত্তোলনের চুক্তি শুরু হয়েছিল (এবং কথিত আছে যে, সে সময়েই জ্বালানী তেল পাওয়া গেলে কোনও উচ্চবাক্য করা হয়নি); আশির দশকে (এরশাদ সরকারের আমলে) কাফকো সারকারখানার জন্য আন্তর্জাতিক বাজার দামের প্রায় এক-চতুর্থাংশেরও কম দামে গ্যাস সরবরাহের চুক্তি করা হয়েছিল; নব্বুইয়েরদশকে ভূগর্ভ থেকে গ্যাস উত্তোলনে উৎপাদন ভাগাভাগি চুক্তির আওতায় যৌথ খরচ নিরূপণ কমিটি’র সদস্যেরা এবং তাদের মাধ্যমে অন্যান্য সরকারী ও রাজনৈতিক কর্মকর্তারা অতি নগণ্য ব্যাক্তি লাভের আশায় দেশের (বিশাল পরিমাণ) স্বার্থজলাঞ্জলি দিতে দ্বিধা করেনি; এবং সহস্রাব্দের শেষ কয়টি বছরে আকস্মিকভাবে বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত্ব মজুতের ধুয়ো তুলে এদেশের খরচায় পাইপলাইন নির্মান করে গ্যাস রপ্তানির প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল। নতুন সহস্রাব্দের শুরুতেই অবশ্য আমরা জ্বালানী সংকটের সাথে পরিচিত হই এবং কয়লা ও জ্বালানী নীতিতে স্থবিরতার পাশাপাশি ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ লক্ষ করি। তারপর রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্রমাগত অস্থিরতা বাড়তেই থাকে – দু’বছরের (২০০৭ ও ২০০৮) বিরল শাসন-ব্যবস্থায় অনেকগুলো জড়পদার্থ যেমন দূর হয়েছে, তেমনি অনেক সম্ভাব্য দেশজ পুঁজি গঠনের ধারা ব্যহত হয়েছে। ২০০৯-এর পর নতুন সরকারের উদ্যোগে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিরসন সকলের মনে সাময়িক আশা জাগিয়েছিল, এবং তাদের আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো পরিকল্পনায় অনেকের মনে হয়েছিল যে দেশটি নতুন উন্নয়ন সোপানে পা দিতে চলেছে। গত প্রায় পাঁচ বছরের অনেকগুলো ঘটনা বাংলাদেশী ও বাঙ্গালী মনকে দিশেহারা করে তুলেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা; বৃহৎ প্রকল্প অর্থায়নে টানাপোড়ন ও বিশ্বব্যাংকের সাথে বাংলাদেশ সরকারের প্রকাশ্য বিরোধ; সেতু তৈরিতে না এলেও সেই ঋণের অর্থ একই সরকারের দ্বারা স্বল্প-আকর্ষনীয় খাতের (সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ও খাদ্য-গুদাম তৈরির) জন্য গ্রহণ;  অজানা কারণে গ্রামীণ ব্যাংক ও তার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ইউনুস-কে চিহ্নিতকরে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ (আর্থিক লেনদেনে গুরু অপরাধ যেখানে নজরে আসে না); সুন্দরবনের সম্ভাব্য ধ্বংসকে মেনে নিয়ে রামপালে বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা; ভারতীয় ঋণনিয়ে সেদেশের পণ্য চলাচলে সেখানকার রেলব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্রডগেজ-এ এখানকার রেল-ব্যবস্থাকে প্রসারিত করা; বড়পুকুরিয়াতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের পাইলটিং অবধি আলোচনা গড়িয়ে ‘কয়লা নীতি’র থমকে দাঁড়ানো;  ফ্লাইওভার-এর প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়ে কাংখিত মেট্রো রেল তৈরি বিলম্বিত করা ও (অনেক ক্ষেত্রে, ফ্লাইওভারে জায়গা ধার্য হওয়ায়) তার সহজ বিস্তৃতি বিঘ্নিত করা; শিল্পায়নের লক্ষে ইকনোমিক জোনের চিরচারিত প্রথা থেকে বেরিয়ে এসে দেশ-ভিত্তিক এলাকা ইজারা দেয়ার উদ্যোগ; ইত্যাদি অনেককেই ভাবিয়ে তোলে। এসবের পাশাপাশি বিগত বছরগুলোতে আর্থিক ব্যবস্থায় উপর্যপুরি বিপর্যয় এবং সেসব বিষয়ে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা বানির্লিপ্ততা সকলকে বিস্মিত করেছে। সেইসাথে রাজনৈতিক অঙ্গনের বিভেদকে ব্যবসার ক্ষেত্রে টেনে এনে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান দূর্বল হওয়ায় সম্পদ-দেশান্তর ও অভিবাসন তরান্বিত হয়েছে। এমনকি অর্থনীতিক কর্মকান্ড পরিচালনায় অপেশাদারিত্ব ও ভ্রান্ত নীতি (এমনকি) বৈধপথে সম্পদ-পাচারের সুযোগ করে দিয়েছে। এসবের মাঝে শ্রম-রপ্তানী নির্ভর অর্থনীতিক প্রবৃদ্ধিরহারে তুষ্ট থেকে সার্বিক অর্থনীতি কিছুটা দিশেহারা। এবং সদিচ্ছা থাকলেও, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্বার্থের টানাপোড়নে দেশজ অর্থনীতিতে গতি আনা দুরূহ হয়ে পড়েছে। খাজনা-আদায়ের রাজনীতি যখন নগ্ন পেশী (ও অস্ত্র) শক্তির উপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়, এবং সরকারী প্রশাসনব্যবস্থা যখন জন-বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে, অর্থনীতিক গতি আনা আরও কঠিন হয়। আজ তাই, উল্লেখজনক কোনও বিরোধী রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি না থাকলেও, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় প্রায়োগিক পর্যায়ে বহুধা-বিভক্ত কর্তৃত্ব বিরাজমান এবং এদের অনেকেই লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে যাচ্ছে। নেওমী ক্লাইন-এর ‘দ্য শক থেরাপী’ বইটি পড়ে মনে হয়, যেন কোনও অদৃশ্য শক্তি আমাদেরকে বারংবার বিচারবিহীন হত্যা, গুম, ধর্মস্থানের অবমাননা, ইত্যাদি অপকর্মের সাক্ষী হতে বাধ্য করে সেই শক্তি’র সৃষ্ট ‘নিয়তি’র কাছে নতিস্বীকার করবার জন্য আমাদের প্রস্তুত করছে! দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অসহায়ত্বের নিরবিচ্ছিন্ন বেত্রাঘাত মানুষকে প্রায়শই নির্জীব করে তোলে। এবং অসহনীয় হয়ে উঠলে আত্মঘাতী উগ্র স্বেচ্ছাচারিতায় তারপ্রকাশ ঘটতে পারে।

রাষ্ট্র যখন সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থ, তথ্যের বিভ্রান্তি যেখানে সর্বগ্রাসী এবং কাঁটাতারের দেয়ালে আবদ্ধ এই ক্ষুদ্র ভূখণ্ড ও তার জলসীমা যখন নানাকারণে ভিনদেশী স্বার্থেরকাছে আকর্ষনীয় হয়ে উঠে, তখন নির্ভরযোগ্য সীমিত তথ্য যুক্তিকাঠামোতে ফেলে পরিচ্ছন্ন ভাবনা জরুরী। আলোচনা ও বর্ননাকে দীর্ঘায়িত না করে আবারো যোগাযোগব্যবস্থার দিকে নজর দিব এবং তা থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু অনুসিদ্ধান্তে পৌছুতে চেষ্টা করবো।

মনে পড়ে, ছ’সাত বছর আগে, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কয়েকজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অর্থনিতিবিদদের সাথে আলোচনায় প্রশ্নটি উত্থাপন করা হয়েছিল — বাংলাদেশ কি কারণে বহিঃবিশ্বের কাছে আকর্ষণীয় মনে হবে? মোটাদাগে চারটি সম্ভাব্য কারণ চিহ্নিতকরা হয়েছিল, (১) স্বল্প-মজুরীর শ্রম ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন, যা অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক বা বহিঃবিশ্বে বাজারজাতের জন্য হতে পারে; (২)  এখানকার স্থল বা জলসীমায় সম্ভাব্য কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, জ্বালানী  তেল বা অন্যকোনও দূর্লভ খনিজ প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকলে তা উত্তোলনের জন্য; (৩) আঞ্চলিক সংযুক্তি বৃদ্ধির প্রয়োজনে (উভয় ভারতের ট্রানজিট চাহিদা ও নেপাল, ভুটান ও পূর্ব এশীয় দেশের সাথে সংযুক্তির জন্য) বিবিধ যাতায়াত ব্যবস্থায় বিনিয়োগ; এবং (৪) আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে সামরিক কৌশলেরক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থানের গুরুত্ব বিধায় নিরাপত্তা-সেবায় বিনিয়োগ। লক্ষণীয় যে, (১ নম্বরে উল্লেখিত) পণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগ, জ্বালানীর সহজ-লভ্যতার কারণে, অথবা,স্বল্প-দূরত্বের আঞ্চলিক বাজারে অনুপ্রবেশের সুবিধার কারণেও হতে পারে। এমনকি, পরিবেশ-ব্যবস্থাপনার দূর্বলতার সুযগ নিয়ে নতুন বিনিয়োগের মোড়কে, চীন, জাপান, বা অন্য কোনও দেশ থেকে পরিবেশ দূষণকারী শিল্প বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হতে পারে। জ্বালানীর সহজলভ্যতা যেমন বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে পারে, তেমনি, আঞ্চলিক সংযুক্তির উন্নতিসাধন পরিবহণ খরচ কমিয়ে বিস্তৃতবাজার নিশ্চিত করলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে দুটো ক্ষেত্রেই ভিন্ন সম্ভাবনাকে বাতিল করা যায় না — (১) জ্বালানী পাওয়া গেলেই যে তা এ ভূখন্ডে ব্যবহৃত হবে, সেটা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়; এবং (২) আঞ্চলিক সংযুক্তি বাড়লেই যে তা এখানকার উৎপাদিত পণ্যের বাজার নিশ্চিত করবে, তা নাও হতে পারে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার ঘাটতি দেখা দিলে ভিন্ন দেশের উৎপাদনকারী তাদের লাভ নিশ্চিত করবার জন্য জ্বালানীর দখলী নিবে (অথবা সমুদ্র-তলদেশে সংযুক্ত সাধারণ ক্ষেত্র থেকে পৃথকভাবে গ্যাস উত্তোলনে বাঁধা সৃষ্টিকরবে), এবং তাদের তৈরি পণ্য পরিবহণ করে নতুনবাজার দখল করতে চাইবে।

উপরের পরিচ্ছেদে বহুবিধ সম্ভাবনার — আশা ও দুঃস্বপ্নের কথা উল্লেখ করেছি। এসব এপর্যায়ে বায়বীয় মনে হলেও বর্তমান সমাজ ও রাজনীতি’র বহুধা-বিভক্তি বহুলাংশে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মাঝে সমঝোতার অভাবের ইঙ্গিত দেয়। আজ তাই, এ ভূখন্ডের সমাজ ও অর্থনীতি একাধিক পথের প্রবেশমুখে অনিশ্চয়তায় হতবাক। সম্ভবত সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোন দ্বারে আমরা প্রবেশ পাবো, সেটা কি আমাদের নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণে আছে? অথবা, দেশের অটুটতা অক্ষুণ্ণ রেখে বাইরের শক্তিকে সম্মানের সাথে মোকাবেলা করার জন্য কি অভ্যন্তরীণ ঐক্যকে সুদৃঢ় করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে? আগেই উল্লেখ করেছি, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রায় দু’দশকের অধিককাল জুড়ে ঢাকা-কেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা সুদৃঢ় হওয়ায় দেশ ও জাতি’র পরিচিতি স্বকীয়তা পেয়েছিল। যমুনা সেতুরমাধ্যমে বৃহত্তর রাজশাহী’র সাথের পূর্বাঞ্চলের সংযুক্তি, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে বিশাল দক্ষিণাঞ্চলের সাথে ঢাকা ও পূর্বাঞ্চলের অধিক সংযুক্তি ও দক্ষিণে সহজ মূল্যে জ্বালানী সরবরাহের সম্ভাবনা, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন বিশিষ্ট রাস্তা, ইত্যাদি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সংযুক্তিকে বৃদ্ধি করবে। এর পক্ষান্তরে, বড় শহরে গন-পরিবহন বা ম্যাস ট্রানজিট (যেমন, মেট্রো রেল)-এ বিনিয়োগ না করে যদি দেশের মূল শহর এড়িয়ে ফ্লাইওভার দিয়ে ভিন্ন দেশের পণ্য পরিবহণ সহজ করা হয়, তা এখানকার বিনিয়োগকে অবহেলা করার ইঙ্গিত দিবে। একইভাবে, যদি আসামের সাথে বাংলাদেশের সংযুক্তি উন্নত না হয়ে তা ত্রিপুরা’র সাথে সীমাবদ্ধ রাখা হয়, বাজার-প্রাপ্তির সম্ভাবনা সীমিত হবার কারণে এ ভূখণ্ড বিনিয়োগের জন্য কম আকর্ষনীয় হবে। অথবা,পদ্মা সেতুনা হয়ে যদি দ্বিতীয় যমুনা সেতু তৈরি হতো এবং সড়ক ও রেলপথে আসামের সাথে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি ঘটতো, তা পশ্চিম ভারতে সম্পদ স্থানান্তরের ইঙ্গিত দিত। এমনকি, নৌপরিবহনের উদ্দেশ্যে ত্রিপুরার সাথে চট্টগ্রাম অথবা মেঘালয়ের সাথে রাখাইনের সমুদ্র বন্দরের সংযুক্তি একই ইঙ্গিত দিতে পারে।

আমার মত পাঠকেরাও সম্ভবত এই বহু সম্ভাবনাময় ‘যদি’র মাঝে খেই হারিয়ে ফেলেছেন। তিন পর্বের বিশদ আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিনিয়োগের পেছনে কোন না কোন উদ্দেশ্য থাকে, যা সম্পদ, পণ্য বা শ্রমপরিবহণ অথবা সামরিক নিরাপত্তা’র সাথে যুক্তহতে পারে। তাই কি ধরনের যোগাযোগ প্রকল্প কার্যকর (বাস্তবায়ন) হচ্ছে এবং কোনগুলো থমকে দাঁড়িয়ে থাকছে, সেগুলো নজরদারীতে আনলে সমাজ ও অর্থনীতি কোন পথে এগুবে তা অনেকটাই আঁচ করা সম্ভব। এই অনুমানে ভর করে, দেশীয় ও আঞ্চলিক যোগাযোগ খাতের কয়েকটি প্রকল্পের উল্লেখ করবো এবং পদ্মা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্রের এই অববাহিকার আগত দিনের সমাজ-রাজনীতি সম্পর্কে আলোকপাত করে দীর্ঘ নিবন্ধটি শেষ করবো।

পুনরাবৃত্তি হলেও দেশের অভ্যন্তরের কিছু উদ্যোগ উল্লেখকরা যাক। এ অংশে যা উল্লেখ করছি তার বেশ কিছু অংশ আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইট (www.albd.org) থেকে নেয়া; এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে দেখা বা দেশের নাগরিকদের মাঝে যা প্রচার করা হচ্ছে।

(১) গ্রাম, ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে রাস্তাঘাট নির্মানের কাজ-এর ক্ষেত্রে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো প্রাধান্য পাচ্ছে -তবে, আইল্যা বিধ্বস্ত বিশাল এলাকায় পানি-নিয়ন্ত্রণের সুব্যবস্থা আজ অবধি করা হয়নি।

(২) চীনা অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তায় পদ্মা সেতু ও দু’পাড়ের রাস্তাঘাট তৈরিতে যথেষ্ট গুরুত্ব লক্ষণীয়;

(৩) পায়রা বন্দরের কাজে অগ্রগতি হচ্ছে বলে শোনা যায়, যদিও এর কার্যকরী ব্যবহারের জন্য যে সাবমেরিন প্রয়োজন, তা (পত্রিকা’র সংবাদ মতে) চীন থেকে কেনার পুরনো সিদ্ধান্ত রদবদলহতে পারে।

(৪) সোনাদিয়া-তে গভীরসমুদ্র বন্দর এবং পৃথকভাবে এল,এন,জি, টার্মিনাল নির্মানের গুঞ্জরন শোনাগেলেও কোনও কার্যকরী পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

(৫) মেট্রো রেল এর কাজ অনেক বিলম্বে শুরু হয়েছে এবং সরকারী-বেসরকারি পার্টনারশিপের আওতায় ফ্লাইওভার-এর কাজ শুরু হওয়ায় মেট্রো রেল-এর কাজ আশানুরূপ গতিতে সম্পন্ন হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে জয়দেবপুর অবধি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ-এর ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রশস্ত রাস্তা ও ফ্লাইওভার-এর প্রকল্প ময়মনসিংহ হয়ে জামালপুর পর্যন্ত বিস্তৃত হবার কথা শোনা যায়। প্রথম পর্বের কাজের বিশাল অগ্রগতি হয়েছে বলে দাবী রয়েছে। এমনকি জয়দেবপুরে টার্মিনাল-এর জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।

(৬) ভারতীয় ঋণে রেলপথ পুনর্গঠনের জন্য বিনিয়োগের উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কিছু দিক পরিবর্তন লক্ষণীয়, যা সাময়িক হতে পারে। যমুনা সেতু দিয়ে, অথবা জকিগঞ্জ-বদরপুর অথবা পদ্মা সেতুকে জড়িয়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলে রেলপথ উন্নয়নের কথা শোনা গিয়েছিল, তা আপাততঃস্থগিত মনে হয়। লক্ষণীয় যে, অধিক গুরুত্ব দিয়ে আগারতলা-আখাউড়া এবং আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ সংযোগ-এর কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। লাকসামে (দু’লাইনের) ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের সাথে যুক্ত হলে এই বিনিয়োগ ত্রিপুরাকে চট্টগ্রাম-এর সাথে সংযুক্ত করবে।

(৭) তথ্য-যোগাযোগের পূর্নাঙ্গ আলোচনা সীমিত তথ্যের কারণে সম্ভব নয়। তবে উল্লেখ্য যে, দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল কুয়াকাটা দিয়ে বাংলাদেশের ভূস্থলে প্রবেশ করবে, যা পায়রা বন্দর সংলগ্ন। দেশের ভিতরকার সংযুক্তির গ্রাহক-পর্যায়ের দাম কমাতে না পারলেও সাবমেরিন ক্যাবল থেকে প্রাপ্ত ব্যান্ড-উইডথ-এর এক উল্লেখজনক অংশ ভারতের কাছে বিক্রিকরা হয়েছে, যা উত্তর-পূর্বের প্রদেশগুলোর সাথে মূল ভূখণ্ডের তথ্য সংযুক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। আগেই উল্লেখ করেছি, মোবাইল সংযোগ ও স্যাটেলাইট-নির্ভর তথ্য আদানপ্রদানে ভারতের মূল ভূখণ্ডের উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধিপাচ্ছে। আরও উল্লেখ্যযে, বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট তৈরি হলেও তা উৎক্ষেপণের এবং তার যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অন্যের উপর নির্ভর করতে হবে।[7]

(৮) নৌপথের আলোচনা এ’নিবন্ধে করাহয়নি। তথাপি উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের নদী ও সমুদ্র সীমানা দিয়ে নৌযান চলাচল সংক্রান্ত বাংলাদেশ-ভারত চুক্তিমাত্র কদিন আগে একনেক-এর অনুমোদন পেয়েছে। আশুগঞ্জে নৌ-টার্মিনাল স্থাপনের কাজ দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করা হবে এমন আভাস দেয়া হয়েছে। এমনকি নৌপথ ‘বিপদমুক্ত’ করবার উদ্দেশ্যে প্রকল্প হাতে নেয়ার তথ্য বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়।[8]

(৯) আওয়ামী লীগের উল্লেখিত ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ২০১৪ সনের ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় সরকারী তেল কোম্পানি ও,এন,জি,সি ভিদেশ, একই বছরের মার্চ মাসে পেট্রোবাংলা’র সাথে যৌথভাবে অষ্ট্রেলীয়-সিঙ্গাপুরী সান্তোষ-ক্রিস কোম্পানিকে, এবং ডিসেম্বর মাসে স্টাটওয়েল ও কনকো-ফিলিপের যৌথ উদ্যোগকে সমুদ্রগর্ভে গ্যাস ও তেল অনুসন্ধানের চুক্তি দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনও লক্ষণীয় উদ্যোগ-এর সংবাদ পাওয়া যায়নি।

(১০) জ্বালানী খাতের গুরুত্ব অপরিসীম; এবং বিদ্যুৎ খাতে, বিশেষত আন্তঃদেশীয় বিদ্যুৎ প্রবাহে সর্বাধিক সরকারী উদ্যোগ লক্ষণীয়। সম্ভবত, এর সাথে কয়লানীতি’র থমকে দাঁড়ানোও জড়িত। মূল উদ্যোগগুলো সংক্ষেপে নিম্নেউল্লেখ করছিঃ

–     রুপপুর আণবিককেন্দ্র ধীর গতিতে চলছে।

–     জাপানী প্রস্তাবনায় মাতারবাড়ি জ্বালানী চক্রকেন্দ্র শুরুতে জল্পনা মনে হয়েছিল — পদ্মা সেতু অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক মুখ ফিরিয়ে নিলে প্রকল্প ঋণে চীনা আগ্রহের পাল্টা উদ্যোগ হিসেবে অনেকেই এই জাপানী প্রস্তাবকে স্বল্পকালীন গণ্য করেছিলেন। কিন্তু সরকারী ব্যবস্থাপনায় “কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড” নামের কোম্পানি কাগজে-কলমে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে; কথিত যে, এ কোম্পানী’র মাধ্যমে জাইকা’র অর্থায়ন হবে; এবং এবারকার বাজেটে ফাস্ট ট্রাকে প্রকল্পটি গণ্য করে পরিকল্পিত ৪টি ১২০০মেগা ওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথমটি স্থাপনের কাজ শুরু করবার সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।

–     বহরমপুর-ভেড়ামারা সংযোগ ও পালাটানা’র বিদ্যুৎ ত্রিপুরা-কুমিল্লা’র সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে;

–     রামপালে ১৩২০ মেগা ওয়াট-এর থার্মাল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের কথা চলছে বেশ কিছুদিন এবং জানা যায় যে এজন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে (বা সম্পাদিত হয়েছে)। বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারি তথ্যসূত্র থেকে জানা যায় যে, রামপালে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হলে তা ভারত-মুখে প্রবাহিত হবে – অনুমান করা হোয় যে, সাগর দ্বীপের সমুদ্রবন্দর ও সম্ভাব্য নৌঘাঁটি নির্মানে সে বিদ্যুতকে কাজে লাগানো হবে। শুধু তাই নয়, পদ্মা সেতু-নির্মানের কাজ শেষ হলে একটি আঞ্চলিক গ্রিড ত্রিপুরা থেকে মানিকগঞ্জ হয়ে পদ্মা পেড়িয়ে দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করবে; এবং (পরিকল্পিত) রামপালে তৈরি বিদ্যুৎ সে গ্রিডের সাথে সংযুক্ত থাকবে।

–     বড়পুকুরিয়াতে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন-ক্ষম কয়লা-নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। জানামতে, ২৫০ মেগাওয়াট-এর তৃতীয় ইউনিট-টি কেবিনেটের ক্রয় কমিটির অনুমোদন পেয়েছে এবং ২০১৬ সনের মার্চ থেকে কাজ শুরু হবার কথা। উল্লেখ্য যে, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে উত্তোলিত কয়লা ব্যবহার করেই এই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।

–    সবচাইতে গুরুত্ত্বপূর্ণ, অথচ স্বল্পাধিক আলোচিত প্রকল্পটি হলো, অরুণাচল প্রদেশে উৎপাদিত জলবিদ্যুৎ হাই ভোল্টেজ ডি,সি/এ,সি  লাইন দিয়ে আসাম, বাংলাদেশ, বিহার হয়ে আগ্রা অবধি নিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে। নেট ঘাঁটলেই জানা যায় যে এই আঞ্চলিক গ্রিডটি অরুণাচলের বিদ্যুৎ বনগাঁইগাঁও দিয়ে বাংলাদেশের জামালপুর ও বড়পুকুরিয়া হয়ে বিহারের পূর্নিয়া দিয়ে আগ্রা পর্যন্ত বিস্তৃত হবে, যা ভারতীয় গ্রিডের সাথে যুক্ত থাকবে। ভুটান থেকে আসা বিদ্যুৎ বনগাঁইগাঁও-তে এসে মিলবার কথা, এবং নেপালে তৈরি বিদ্যুৎ পূর্নিয়াতে পশ্চিমমুখী গ্রিডটির সাথে যুক্ত হবার কথা। পূর্বে উল্লেখিত বড়পুকুরিয়াতে তৈরি বিদ্যুৎ এই গ্রিডের সাথে যুক্ত হয়ে পশ্চিমমুখী হবে, না কি তা দক্ষিন-মুখী হয়ে বাংলাদেশের অন্যত্র বিদ্যুৎ যোগান দিবে, সেটা স্পষ্ট নয়। তবে ২০৩০ সনের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী প্রায় ৩৫০০ মেগাওয়াট পরিমাণ (মোট প্রাপ্তি’র ৯%) বিদ্যুৎ আঞ্চলিক গ্রিড থেকে আসবে। পরিশেষে লক্ষণীয়, সুইডেনের যে এ,বি,বি, কোম্পানিকে ভারত সরকার হাইভোল্টেজ লাইনটি স্থাপনের দায়িত্ব দিয়েছে, সেই একই কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩০ মিলিওন ডলার প্রকল্পে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বলে যায় (সূত্রঃ আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইট)।

(১১)  ঢাকা-সিলেট-তামাবিল হয়ে গুয়াহাটি পর্যন্ত রাস্তা এশিয়ান হাইওয়ে’র অংশ হিসেবে গণ্য করা হলেও, শোনা যাচ্ছে যে মোদী সরকার আসার পর এপথ দিয়ে পণ্য পরিবহণের পরিকল্পনা বাদ দেয়া হয়েছে। এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মূল সংযুক্তি আখাউড়া-আগারতলা এবং আগারতলা থেকে মেঘালয় পথেই ভাবা হচ্ছে।

উপরে বাংলাদেশকে ঘিরে যোগাযোগ ব্যবস্থা-সংশ্লিষ্ট সমকালীন কার্যক্রম ও ভাবনা উল্লেখ করেছি। সার্বিক চিত্র থেকে প্রতীয়মান হয় যে,

(১) দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলের (নেপাল, ভুটান, উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল) জলবিদ্যুৎ দীর্ঘস্থায়ী গ্রিডব্যবস্থার মাধ্যমে পশ্চিমাঞ্চলের কলকারখানা ও বসতির চাহিদা মেটানোর জন্য নেয়া হবে। প্রাথমিকভাবে, ত্রিপুরার প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে তৈরি বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আমদানি হলেও পরবর্তীতে পদ্মা সেতু নির্মিত হলে, তা ভেড়ামারা-বহরমপুর দিয়ে পশ্চিম বাংলায় প্রবাহিত হবার সম্ভাবনা রাখে। এমনকি বাংলাদেশ-এর কয়লা ব্যবহার করে অথবা কয়লা আমদানি করে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ শেষাবধি কোথায় ব্যবহৃত হবে, তা নিশ্চিতকরে বলা সম্ভব নয়।

(২) ঢাকা-চট্টগ্রাম চার-লেন বিশিষ্ট সড়ক তৈরীর বিলম্ব এবং পাশাপাশি আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ নিয়ে ব্যস্ততা ঢাকাকে ঘিরে রপ্তানী-নির্ভর শিল্পকে নিঃসন্দেহে বিপাকে ফেলবে। যদি সেই মহাসড়কের পার্শ্ববতী ইকনোমিক জোন তৈরি করার কারণে এ বিলম্ব ঘটে, কেবলমাত্র সেক্ষেত্রেই এটার ভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব।

(৩) ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যে বাজারের সম্ভাবনা একসময় বাংলাদেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির আশা জাগিয়েছিল, সেটা সম্ভবত অমূলক। যাত্রী পরিবহণের দিকে গুরুত্ব দেয়ায় মনে হয় যে, সেখান থেকে অভিবাসনকে উৎসাহিত করা হবে, যা সাধারণত, নির্দিষ্ট এলাকা থেকে সম্পদ আহরণের সাথেসাথে দেখা যায়। এবং বাংলাদেশে, বিদ্যুৎপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা গেলে, সীমিত কিছু এলাকায় শিল্প প্রতিষ্ঠা’র সম্ভাবনা রয়েছে।

(৪) একসময় অনেকেই বাংলাদেশকে আঞ্চলিক যোগাযোগের সংযুক্তি স্থলহবার সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী ছিল — স্থলপথ দিয়ে (এশিয়ান হাইওয়ে’র দ্বারা) দক্ষিন-পূর্ব বা পূর্ব এশিয়া’র সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সে আশা আজ নিতান্তই ক্ষীণ। এমনকি সমুদ্রপথেও দক্ষিণ ও পূর্বের দেশগুলোর সাথে সংযুক্তি আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করার সম্ভাবনা দিনদিন ক্ষীণ হচ্ছে।

উল্লেখ না করলেই নয় যে, মিয়ানমারের শোয়ে’তে চীনের জ্বালানী-তেল ও গ্যাসের টার্মিনাল গঠন বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলের ভৌগলিক-রাজনীতিতে নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। সমকালীন ঘটনা থেকে মনে হয় যে, সে বিনিয়োগ রক্ষার্থে বা তা হুমকিতে ফেলতে এ ভূখণ্ড ব্যবহৃত হবার সম্ভাবনা দিনদিন বাড়ছে। সেইসাথে, নিরাপত্তাবাহিনী নির্ভর সমাজ ও রাজনীতি জেঁকে বসার সম্ভাবনাটা প্রকট হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর ব্যাতিক্রম ঘটবে যদি সত্যি জ্বালানী পাওয়া যায় এবং তা দেশের ভিতরকার কর্মসংস্থান-মূলক বিনিয়োগকে তরান্বিত করে, এবং সেই স্বপ্নের বিনিয়োগকারীরা নিজেদের স্বার্থে এ ভূখন্ডের সমাজ ও রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা রাখতে সচেষ্ট হয়। মাতারবাড়িতে যে বিশাল বিদ্যুৎ মহাচক্রকেন্দ্র তৈরীর প্রস্তুতি চলছে, তা সামরিক কৌশল-জনিত প্রয়োজনে ব্যবহার করা হবে, না কি, দেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পায়নের কাজে ব্যবহৃত হবে, তা জানারজন্য আমাদের আরও কিছু বছর অপেক্ষা করতে হবে। আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হয়, উত্তর-পূর্ব ভারতের বাণিজ্য প্রসারের জন্য সেটা প্রয়োজন হবে না।

এই দীর্ঘ নিবন্ধের শুরুতেই বলেছিলাম যে, কোন নির্দিষ্ট যোগাযোগ ব্যবস্থা একটি জনগোষ্ঠী’র উপকারে আসবে না অপকারে আসবে, তা নির্ভরকরছে সে কোন মঞ্চে (বা, সিঁড়ির কোনধাপে) দাঁড়িয়ে ভালোমন্দের বিচার করছে। এপর্যন্ত অধিকাংশ আলোচনা বাংলাদেশ অথবা উপমহাদেশীয় প্রেক্ষিত থেকে করা হয়েছে। তাৎপর্য বিশ্লেষণ না করেই নিবন্ধটি শেষ করবো দুটো আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত উল্লেখ করে।

ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (সমঝোতা)-এর আওতায় বর্তমানে ১২ টি দেশ আছে — অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনেই, চিলি, জাপান, মালয়েশিয়া, পেরু, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম, মেক্সিকো, কানাডা ও নিউজিল্যান্ড। অনেক বিশ্লেষকের দৃষ্টিতে, এই মঞ্চ ব্যবহার করে যেমন চীন-ঘেরাও করার মার্কিনী নীতি কার্যকর করার প্রয়াস থাকবে, তেমনি এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের জন্য ৬০০’র ও অধিক কর্পোরেট গ্রুপের সম্মিলিত উদ্যোগ এর পেছনে কাজ করছে। প্রকাশিত বিভিন্ন নিবন্ধে আশ্চর্য্যজনকভাবে বঙ্গোপসাগর অনুল্লেখিত রয়েছে, এবং গভীরসমুদ্রের নৌচলাচলের পথ ভারত মহাসাগর দিয়ে দক্ষিণ ভারত ভূখণ্ড স্পর্শ করে বৈশ্বিক সংযুক্তি আনবে বলে ধারনা দেয়া হয়। স্মরণ করা যেতে পারে যে ভারত উল্লেখিত সমঝোতা’র সদস্য দেশ না হলেও ‘কটন রুট’-এর নামে সেদেশের সরকারের উদ্যোগকে অনেকেই সমগোত্রীয় মনেকরেন। তবে এটাও অনস্বীকার্য যে চীনের উদ্যোগে গঠিত অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকে ভারতও অর্থ যোগানদিচ্ছে।

উপরোল্লেখিত সমঝোতা’র কার্যকররূপের প্রাথমিক নমুনা আমরা জেনেছি যুক্তরাষ্ট্রের বৈমাত্রেয় সুলভ আমদানি শুল্কনীতি’র মাধ্যমে — বাংলাদেশের কাপড় রপ্তানীকে জি,এস,পি, সুযোগ না দেয়া এবং ভিয়েতনাম থেকে রপ্তানী করা কাপড়কে তাদের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশের অধিকার দেয়ার ঘোষণা এখানে উল্লেখ্য। ভাসমান শরণার্থী ও রোহিঙ্গাদের বর্তমানের বঞ্চনাময় জীবনের পেছনে নতুন পার্টনারশিপ-এর কোন ও ভূমিকা আছে কি না, সেটা তলিয়ে দেখা প্রয়োজন। তবে, যোগাযোগব্যবস্থার প্রেক্ষিতে একটি নিবন্ধের উল্লেখ প্রাসঙ্গিক — এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক ইন্সটিটিউট এর হয়ে, ২০১৪ সনের মে মাসে প্রকাশিত জ্য ফ্রসে গ্যত্রে রচিত “কানেন্টিং সাউথ এশিয়া টু সাউথ-ইষ্ট এশিয়াঃ ক্রস বর্ডার ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট” (দক্ষিণ ও দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার সংযুক্তিঃ আন্তঃদেশীয় অবকাঠামোতে বিনিয়োগ)। নিবন্ধটিতে বৈশ্বিক পরিসরে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পর্কে আগাম ভাবনা’র প্রতি আলোকপাত করেছে। নিবন্ধটির বিশ্লেষণ ও প্রস্তাবনার বিস্তারিততে যাবার সুযোগ নেই। শুধু উল্লেখ করবো যে, মূল প্রস্তাবনায় বাংলাদেশকে এড়িয়ে ‘চিকেন নেক’ কথিত ভারতের দু’অঞ্চলের সংযোগকারী সরু এলাকা দিয়ে মনিপুরের ইমফল দিয়ে কলকাতা বন্দর থেকে সায়গণ বন্দর পর্যন্ত দীর্ঘ সড়কপথের উল্লেখ রয়েছে। বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে যাওয়ার পথ সংক্ষিপ্ত হলেও সেটিকে উপযুক্ত মনে না করার তিনটি কারণ উল্লেখকরা হয়েছে, যা স্পষ্টতই ভারতের স্বার্থের দিকেনজর দিয়ে চিহ্নিত — (ক) চিকেন নেক-এর তুলনায় দুটো বাড়তি সীমান্ত পেরুতে হয়; (খ) টেকনাফ দিয়ে সড়ক সংযুক্তির ক্ষেত্রে মিয়ানমার-এর আপত্তি (অদ্ভুতভাবে নিবন্ধকার সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে ভূপৃষ্ঠ দিয়ে দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ারসাথে সড়ক সংযুক্তিতে বাংলাদেশের আগ্রহ নেই), এবং (গ) বাংলাদেশ-এর মধ্য দিয়ে যাওয়া সড়কপথ নেপাল ও ভূটান-কে সংযুক্তকরার জন্য সুবিধাজনক হবে না।

দীর্ঘ বর্ণনার সমাপ্তি টানবো কয়েকটি মন্তব্য করে। প্রথমতঃ যে কোন ভৌগলিক ও সামাজিকস্বত্ত্বা স্বাধীনভাবে এগুতে পারে যদি তার জলে-স্থলের সম্পদ সেখানকার জনবসতি’র জন্য সুদূরপ্রসারী সম্মানজনক কর্ম-সংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু দক্ষিন-এশীয় উপমহাদেশের ইতিহাস দুঃখজনক ভাবে বারংবার পূর্বাঞ্চলকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। আমরা আশা করবো যে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার সেই ধারাতে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবেন। দ্বিতীয়ঃ বাংলাদেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষে ভারতীয় বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করার প্রয়াস থাকাটা স্বাভাবিক। তবে,সে অজুহাতে, জামালপুর/বড়পুকুরিয়া, মংলা/রামপাল, বা আশুগঞ্জে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নামে বাংলাদেশের দূর্লভ জমি ভারতকে ইজারা দিলে, তা স্পষ্টতই প্রাকৃতিক/জ্বালানী সম্পদের পশ্চিমমুখী প্রবাহকে সহায়তা করবে। এক্ষেত্রে সতর্কতা জরুরী। তৃতীয়ঃ বড় প্রতিবেশী হিসেবে আমরা আশা করবো যে, পণ্য উৎপাদনের উদ্দেশ্যে এবং পূর্বাঞ্চলের বাজার পাবার লক্ষে ভারতীয় বিনিয়োগকারীরা এবং ভারতের সরকার বাংলাদেশে অংশীদারিত্ত্বমূলক যৌথ উদ্যোগে আগ্রহী হবেন, যা সকলের জন্য অধিক শান্তিপূর্ন বন্ধনের পথ উন্মুক্তকরবে। চতূর্থঃ অনেক সময় মনে হয়েছে (যা আমার অনেক ভারতীয় বন্ধুরাও মনেকরেন), চিরচারিত পশ্চিমা শক্তি ও পূর্বের উদীয়মান শক্তির মাঝে ভারসম্য রাখতে যেয়ে ভারতের নেতৃত্ব যে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগেন, তার ভোগান্তি অনেকক্ষেত্রেই বাংলাদেশকে পোহাতে হয়। আমরা আশা করবো যে, এই অবস্থার দ্রুত পরিসমাপ্তি ঘটবে। পরিশেষে মানতেই হবে, আমাদের সমাজ ও অর্থনীতি’র উন্নতি ও সার্বভৌমত্ত্বের অটুটটা নির্ভর করবে কতখানি অর্থনীতিক প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক দৃঢ়তারসাথে যোগাযোগ ও পরিবহন খাতে প্রকল্প বাছাই ও সততার সাথে সেসব বাস্তবায়ন করা হয়, তার উপর।

[নিবন্ধটি লিখতে শুরু করেছিলাম ২০১৫ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে। শেষ করলাম ১লা জুন ২০১৫ তারিখে।]

সাজ্জাদ জহির

Browse the following link to view a shorter version published in The Daily Bonik Barta
http://www.ebonikbarta.com/display2.php?id=23_1&id2=24_2&viewdate=2015-06-06

[1] দর্শন পর্যায়ে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সমগ্র এবং তার অংশ-বিশেষ’কে কে কিভাবে দেখছে, তার উপর ভালোমন্দের বিচার নির্ভরশীল। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকের শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল জনপদকে জল-নিমগ্ন করে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য লাভজনক হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু তা নিঃসন্দেহে সেখানকার চাকমা জনবসতির অপরিসীম দূর্ভোগ এনেছিল।

[2] ২০১৫ সনের মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে ভারতের ভুবনেশ্বরে নয় দেশের প্রতিনিধি নিয়ে একটি সম্মেলনে চীনের উঠতি প্রভাব প্রতিহত করবার মোদী সরকার-এর ত্রিমুখী ‘কটনরুট’ পরিকল্পনার সাথে এর কোনও সম্পর্ক নেই।

[3] যখন লেখাটি এ পর্যায়ে, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী’র (২৯ শে মার্চ, ২০১৫) বক্তব্য নজরে এলো। তিনি বাংলাদেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের পাঁচটি জেলায় (কুষ্টিয়া যেখানে ভেড়ামারা অবস্থিত, ঝিনাইদাহ, যশোর, খুলনা ও বাগেরহাট যেখানে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে) ২০২১ সনের মাঝে ১ কোটি ৫৬ লাখ গ্রাহককে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। একই সাথে তিনি জানিয়েছেন যে পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী ঐ জেলাগুলোতে ২০১৫ সেপ্টেম্বরের মাঝে গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন সম্ভব হবে না, প্রকল্পটির মেয়াদ ২০১৭ সন অবধি বৃদ্ধি করা হয়েছে! গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যখন বিদ্যুৎ প্রবাহের সুযোগ বৃদ্ধি পায়, ‘মাঠ’-পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। পরবর্তী আলোচনায় বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে।

[4] ফর্বেস ম্যাগাজিন-এর ভাষ্য অনুযায়ী চীনকে এই সুবিধা দেয়ার জন্য মিয়ানমার সরকার ৩০ বছরে মোট ৫৩ বিলিয়ন মার্কিনী ডলার রয়্যালটি হিসেবে পাবে।

[5] মাত্র কয়েকদিন আগে ভারতের ভুবনেশ্বরে নয়টি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে “ইন্ডিয়ান ওশ্যানঃ রিনিউইং দ্য ম্যারিটাইম ট্রেড এন্ড সিভিলাইজেশ্যনাল লিঙ্কেজ” শীর্ষক এক সম্মেলনে এসংক্রান্ত মতামত বিনিময় হয়।

[6] উল্লেখ্য যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রাখাইনের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ ছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, গ্যাস টার্মিনাল পাইপলাইন নির্মানের জন্য যে বিপুল পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ প্রয়োজন হয়, তা নিশ্চিত করতে বিশাল জনগোষ্ঠীকে ভিটেচ্যুত করতে হয়। মনে তাই প্রশ্ন জাগে, রোহিঙ্গা শরনার্থী’র উৎস কি সিতওয়ে’র গ্যাস ভাণ্ডারে সাথে জড়িত? এবং থাইল্যান্ড-মালায়েশীয় উপকূলে দাস-শ্রমিক, গণকবর, উত্তাল সমুদ্রে ভাসমান শরনার্থী এবং ব্যাংকক-এর বহুদেশীয় সম্মেলন সেই জ্বালানী-কেন্দ্রিক বিরোধের প্রকাশ কিনা ভেবে দেখা প্রয়োজন।

[7] নির্দিষ্ট ভূখণ্ডকে মুখ্য রেখে উপযুক্ত কক্ষপথে স্যাটেলাইট চালু রাখলে অধিক ঘনঘন (বা বেশী সময় জুড়ে) ঐ ভূখণ্ডের বা সমুদ্রবক্ষের যাবতীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়, যা নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে অথবা অশান্ত সমুদ্রের তলদেশ থেকে গ্যাস বা জ্বালানী তেল উত্তোলনের জন্য করা বিনিয়োগের ঝুঁকি বহুলাংশে হ্রাস করে। সঙ্গতকারণেই বঙ্গোপসাগরে জ্বালানী উত্তোলন বা নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট খাতে বিনিয়োগের আগে উদ্যোক্তারা ডেডিকেটেড (উৎসর্গীকৃত) তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করতে চায়। শেষোক্ত বিষয়ে অগ্রগতি না ঘটলে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণও বিলম্বিত হতে পারে।

[8] যেটা স্পষ্ট নয়, গভীর সমুদ্রগামী বাংলাদেশী মালিকানাধীন জাহাজ (শিপিং) কোম্পানিগুলোর আপেক্ষিক অবস্থান কোন মুখী। ভাসমান শরণার্থী, শোয়ে-তে চীনা বিনিয়োগ এবং বঙ্গোপসাগরে ক্রমবর্ধমান গ্যাস-তেলের অনুসন্ধান সমুদ্রপথে বহিঃবাণিজ্যের স্বাধীনতাকে খর্ব করতে পারে।

Read More 1216