Published on: August 04, 2018
পা রিবারিক কারণে বহুদূর থেকে ঘটমান কিশোর শিক্ষার্থীদের পথে নেমে বৃহত্তর নাগরিক স্বার্থ আদায়ের আন্দোলন বুঝতে চেষ্টা করছি। শাহবাগের গণজাগরণের পর, ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন, কিছুদিন আগে শুরু হওয়া অসমাপ্ত কোটাবিরোধী আন্দোলন এবং চলমান নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুল-শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। সামষ্টিক স্বার্থে ব্যক্তির অংশগ্রহণের চিরন্তন পথগুলো বন্ধ বহুদিন। সে কারণেই এ-জাতীয় আন্দোলনের তাত্পর্য বহুমাত্রিক। এ ধরনের আন্দোলনকে তাই আমি আগামী দিনে সমাজ পরিচালনায় উপযুক্ত করে গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র হিসেবে মনে করি। এসব কিশোরের প্রতি সহমর্মিতা থেকে সমাজ সচেতন আন্দোলনকারীদের জন্য কিছু কথা।
শুরুতেই বলা প্রয়োজন, রাষ্ট্র ব্যবস্থার ধারক-বাহকরা কখনই প্রশাসনবহির্ভূত কারো দ্বারা তাদের কার্য পরিচালনা হোক, তা বরদাশত করবে না। সে আচরণ এমনকি নিষ্পাপ ‘কোমলমতি শিশু’-কিশোরদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই ভয়ঙ্কর চেহারার নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে যেমন ভীত রাখার প্রয়াস বিশ্বব্যাপী চলছে, আমাদের দেশেও তার ব্যতিক্রম নাও ঘটতে পারে। (ট্রাম্প প্রেসিডেন্সির ওপর বব উডওয়ার্ডের সদ্য প্রকাশিত বই ‘ফিয়ার’ দ্রষ্টব্য, যেখানে সম্মান আদায় বা চিরস্মরণীয় থাকার উদ্দেশ্যে নয়, ভীতিসৃষ্ট ক্ষমতার দম্ভের উল্লেখ রয়েছে।) এ কারণেই যেন রাজনৈতিক দিক নির্দেশবিহীন সামাজিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলন আইন ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছু সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন অর্জন করে দু’পা পিছিয়ে এসে ভবিষ্যতের জন্য শক্তি সংহত করে। ভয় পেলে যেমন চলবে না, তেমনি বেপরোয়া হয়ে অরাজকতার পথে বিভ্রান্ত হলে আমাদের বিভক্তি বাড়িয়ে বহিঃশক্তিকেই সহায়তা করা হবে। অর্থাৎ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর মাঝে সংযোগ স্থাপন করে দ্রুত রাস্তা থেকে ক্লাসরুমে ফেরত যাওয়া প্রয়োজন। যদি সরকার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে একাত্ম হয়ে দীর্ঘকালীন আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়া যেতে পারে। আমি আশান্বিত, দেশের কিশোর-তরুণরা বলছে, ‘যদি তুমি ভয় পাও, তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও, তবে তুমি বাংলাদেশ।’ তবে হঠকারিতার সঙ্গে রুখে দাঁড়ালে নিশ্চিহ্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই সশস্ত্র রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে অথবা অযৌক্তিক অনড় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হলে দীর্ঘায়িত প্রস্তুতি ও শক্তি সঞ্চয় আবশ্যক।
দেখে ভালো লেগেছে, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা উপলব্ধি করেছে পরিবহন কর্মীরা তাদের বা সাধারণ নাগরিকের শত্রু নয়। নিঃসন্দেহে ব্যক্তিচালক দুর্ঘটনার নামে মানুষ হত্যা করলে সবাই তার বিচার চাইবে। কিন্তু পরিবহন ব্যবস্থাপনায় যুক্ত টোল আদায়কারী স্বার্থান্বেষী মহল এবং ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত তাদের রক্ষকরা নিঃসন্দেহে আরো বড় দোষী। অতি কঠিন সত্য হলো, সেসব স্বার্থান্বেষী পরিবহন কর্মীকে সমাজের অন্যান্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখবে এবং তাদেরকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের গদি ধরে রাখতে সচেষ্ট হবে। এ কারণেই আগামী কিছুদিনের জন্য হলেও ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত সেসব ব্যক্তিকে অকার্যকর রাখা সরকারের কর্তব্য। ‘স্বার্থের দ্বন্দ্ব’-এর মোড়কে এ-জাতীয় প্রস্তাবনা অন্যত্র দেখেছি। আমি সে যুক্তির বাইরে সরকারকে অনুরোধ করব, বৃহত্তর জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের প্রক্রিয়ায় পরিবহন কর্মীদের সম্পৃক্ত করতে যেন ভিন্ন ব্যক্তিদের ওপর নির্ভর করা হয়। অন্যথায় সমাজ অধিকতর জিম্মি হয়ে পড়বে। উল্লেখ না করলেই নয়, পরিবহন খাত অর্থনীতি ও সামাজিক বন্ধনে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং পরিবহন শ্রমিকদের অবদান অনস্বীকার্য। তাই কিশোর-তরুণ আন্দোলনকারীদের সে ব্যাপারে সংবেদনশীল থাকার অনুরোধ রইল। বলার অপেক্ষা রাখে না, মৃত দিয়ার পিতা একজন পরিবহন কর্মী ছিলেন।
এটি সত্য, রাতারাতি ব্যবস্থার পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়, তবে সে অজুহাতে বর্তমান আন্দোলনকে খাটো করে দেখা বা শত্রুপক্ষের কারসাজি আখ্যায়িত করার চেষ্টা নিন্দনীয়। রাস্তা, ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেল তৈরির কারণে আগামী বেশ ক’বছর চলাচলে বিঘ্ন ঘটবে এবং তা সবাই মেনে নিতে পারে। কিন্তু আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয়ের অভাবে অথবা পথচারী বা নাগরিকের সাধারণ অধিকারের প্রতি অবজ্ঞার কারণে বিপর্যয় ঘটলে তা মেনে নেয়া কঠিন। তাই দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠার সময় এসেছে সর্বস্তরে। অগণিত বাস মালিকানা থেকে বেরিয়ে গুটিকয়েক কোম্পানির হাতে যাত্রীবাহী বাস চলাচলের দায়িত্ব/লাইসেন্স দিয়ে তাদের দায়বদ্ধ রাখার প্রস্তাবনা প্রয়াত মেয়র আনিসের কাছে অনেক দূর এগিয়েছিল বলে জানা যায়। এ ব্যাপারে নীতি পর্যায়ে সিদ্ধান্ত প্রয়োজন, যা বর্তমান মন্ত্রীর নেতৃত্বে করার বিপদ সম্পর্কে আগেই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। উপযুক্ত সময়ে মাস ট্রানজিট ব্যবস্থা প্রবর্তন না হওয়ায় আজ অসংখ্য পরিবারকেন্দ্রিক গাড়ি রাস্তায় নেমেছে এবং সে সঙ্গে অনেক ভালো চালক অধিক বেতনে সেখানে কর্মরত। উপরন্তু গত দু-এক বছরে উবার ও পাঠাও এসে অবস্থাপন্ন মধ্যবিত্ত কর্মজীবীদের জীবনকে সহজ করেছে। এ খাতেও অনেক লাইসেন্সধারী এবং যোগ্য চালক অধিক আয়ের আশায় কর্মরত। তাই বিদেশমুখিতা কমে এলেও সাধারণ যাত্রী পরিবহনে অযোগ্য বাস এবং দুই নম্বর লাইসেন্সধারীর ভিড় জমেছে। পরিবার পর্যায়ে গাড়ির ব্যবহার ও চালক নিয়োগের মাত্রা কমানো গেলে উপযুক্ত চালকের অভাবজনিত সংকট সাময়িক হ্রাস পেতে পারে। আশা করা যায়, মেট্রোরেল চালু হলে এসব চাপ অনেকাংশে লাঘব হবে।
পরিশেষে দুপক্ষের কাছে আবেদন রাখব, আমাদের সীমাবদ্ধতা উপলব্ধিতে এনে শিক্ষার্থীরা যেন এ আন্দোলনকে দীর্ঘায়িত প্রেক্ষাপটে দেখে পদক্ষেপ নেয়। শিক্ষাঙ্গনে ফেরা প্রয়োজন এবং একই সঙ্গে আন্দোলন ভিন্ন আঙ্গিকে চালিয়ে নেয়া প্রয়োজন। সমাজের অন্যান্য অংশ না এলে নিজেদের মাঝে যোগসূত্রতা গড়া এবং নিয়মিত কর্মসূচি নেয়ার মাধ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর স্পৃহা জাগিয়ে রাখা খুবই জরুরি। সেসঙ্গে রাস্তার শিক্ষা পরিবার ও স্কুলের সদস্যের কাছে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। সম্ভব হলে সে বার্তা সমাজের অন্যান্য অঙ্গনে, বিশেষত পরিবহন কর্মীদের মাঝে পৌঁছে দেয়া প্রয়োজন। প্রলম্বিত না করে রাস্তার কর্মসূচি নির্দিষ্ট সময়ে সমাপ্তি ঘটানো উচিত এবং তা সরকারের উপযুক্ত প্রতিনিধিদের জানিয়ে দেয়া উচিত। সেসঙ্গে লক্ষ রাখা প্রয়োজন, নিজেদের মাঝে বন্ধন না থাকার সুযোগ নিয়ে কোনো কর্তৃপক্ষ যেন আগামীতে কাউকে অহেতুক হয়রানি না করে।
সরকারের সিদ্ধান্তে যারা মুখ্য ভূমিকা রাখেন, তাদের কাছে বিনীত অনুরোধ: ১. এক মুখে ‘কোমলমতি’ উল্লেখ করে পর মুহূর্তেই হুঙ্কার ও বিষোদ্গার করা থেকে বিরত থাকুন, ২. জনশক্তির অভাব মেটানোর জন্য আগামী এক বছর স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সহায়তায় রাস্তায় বাস চলাচল তদারকের ব্যবস্থা নিলে সর্বস্তরে আস্থা বাড়বে, ৩. যাত্রীবাহী বাস চলাচল ব্যবস্থাপনায় খাজনা আদায়কারী ‘শ্রমিক-সর্দার’ তুল্য প্রথা থেকে বেরোনো আবশ্যক এবং সে কারণে দায়িত্বশীল পদ থেকে ব্যক্তি অপসারণের যৌক্তিকতা রয়েছে, যা দ্রুত কার্যকর করা প্রয়োজন, ৪. পাঁচ মুখ দিয়ে পাঁচ কথা বেরোনোর সুযোগ দিলে সমাজে অনাস্থা বাড়বে এবং তা থেকে সৃষ্ট বিভক্তির দায়ভার সরকারের ওপর বর্তাবে, তাই অবিলম্বে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যনির্বাহী আদেশে কিছু ব্যক্তিকে নিয়ে গঠিত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটির ওপর দায়িত্ব দিয়ে বর্তমান অবস্থার নিরসন ঘটানো জরুরি। উল্লেখ্য, সরকারপক্ষ থেকে স্পষ্ট অঙ্গীকার দেয়া প্রয়োজন, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে না।
সব পক্ষ যেন বিভাজনের রাজনীতি বর্জন করে রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থ ও অটুটতা রক্ষার জন্য অধিকতর মনোনিবেশ করতে পারে, সেটিই কামনা।
লেখক: অর্থনীতিবিদ; ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক