কালবেলা |
মতামত | উপ-সম্পাদকীয় |
২০ অক্টোবর ২০২৩ |
ড. সাজ্জাদ জহির |
ভূমিকা : প্রস্তাবনার পুনরাবৃত্তি
[কালবেলাতে ২০২৩ সালে প্রকাশিত মূল নিবন্ধের ৩০ আগস্টের প্রথম পর্ব এবং ১৪ সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় পর্ব পড়লে প্রেক্ষাপট বুঝতে সুবিধা হবে। বক্তব্য উপস্থাপনের সুবিধার্থে অনেক ব্যাখ্যা নিবন্ধ-শেষের পাদটীকাতে উল্লেখ করা হয়েছে, যা অনুধাবন জরুরি।]
দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে সংশয় জেগেছিল কয়েকটি প্রেক্ষিত থেকে:
প্রথম: উপনিবেশকেন্দ্রিক বিশ্ব শাসনব্যবস্থার ধারাবাহিকতায় নতুন একটি শ্রেণির আবির্ভাবের ইঙ্গিত গত শতাব্দীর শেষপ্রান্তেই দৃশ্যমান হয়েছিল। বহিঃশক্তির প্রতি আনুগত্য বিস্তৃত হওয়ার ফলে স্বভূমি শাসন (ও শোষণ)-এর সুযোগ যেমন এদের অনেককে প্রলুব্ধ করে, তেমনি, বিশ্ব-পরিসরে অসম ক্ষমতা-বিন্যাসকে মেনে নিয়ে তাদের অনেকে শেকড়ের মাটিকে সমৃদ্ধ করায় অবদান রাখতে আগ্রহী হন। এদের ‘যাযাবর বিত্তশালী’ (নোম্যাড ক্যাপিটালিস্ট) গণ্য করলে ভুল হবে। যাযাবর বিত্তশালীরা নির্দিষ্ট কোনও দেশে স্থায়ী বসবাসের স্বাচ্ছন্দ্য খোঁজে না। অথচ, দ্বৈত নাগরিকরা, একাধিক দেশের শ্রম, অর্থ ও রাজনীতিসহ বিভিন্ন সেবার বাজারে, জীবনের বিভিন্ন পর্বে স্থান পরিবর্তন করলেও, তাদের ব্যক্তি-সম্পদ সংগৃহীত (পুঞ্জীভূত) হয় সুনির্দিষ্ট একটি (অধিক-উন্নত) দেশে। সংগত কারণেই এই শ্রেণির বিস্তার ও সমৃদ্ধি (অভিবাসনের) উৎস ও গন্তব্য দেশের জন্য সমধর্মী প্রভাব রাখে না। স্বল্পোন্নত দেশের উন্নয়ন-ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য এই উদীয়মান জনগোষ্ঠীর চরিত্র অনুধাবন প্রয়োজন।
দ্বিতীয়: আন্তঃদেশীয় অর্থপ্রবাহে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে অর্থপাচারের বিষয়টি দুই যুগের অধিককালজুড়ে জনসমক্ষে বহুল আলোচিত। এককালে, অনেকে স্বল্পোন্নত দেশের অর্থনীতিতে ঋণ আত্মস্থ (অ্যাবজর্ব) করবার সীমিত সক্ষমতাকে অর্থপাচারের কারণ হিসেবে গণ্য করতেন। একইসঙ্গে অবশ্য, মুনাফা, ব্যাংক সুদের এবং মুদ্রাবিনিময়ের বর্তমান ও প্রত্যাশিত হারে তারতম্য, বাজারভিত্তিক বিশ্লেষণে গুরুত্ব পেয়েছে। সেই ব্যাখ্যায় বিভ্রান্তি দেখা দেয় যখন ‘আইনবহির্ভূতভাবে অর্থের স্থানান্তর (ও অর্থাগার পরিবর্তন)’ এবং ‘জঙ্গিবাদ অর্থায়ন’- বিরোধী আইন প্রবর্তন করা হয়। এই (AML/CFT) আইনের ফাঁদে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সরকার সেসব দেশের ব্যক্তিপর্যায়ের আন্তঃদেশীয় আর্থিক লেনদেনের তথ্য স্ব-উদ্যোগে ‘পাচার’ করে। অথচ একই সময়ে, উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বেশ কিছু দেশে যে বিপুল পরিমাণ অর্থপাচার হয়েছে, সেসব (গন্তব্য) দেশের সরকার তাদের এই প্রাপ্তির ব্যাপারে নীরব থেকেছে। এমনকি যেসব দেশ থেকে অর্থপাচার হচ্ছে, সেসব দেশের সরকারের মাঝে তথ্য জানার উদ্যোগ নেই, বা জানলেও, কোনও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। এটা আজ সকলেই স্বীকার করেন যে, এই দীনতার বড় কারণ, এই দেশগুলোর সরকারে একটি উল্লেখজনক ও শক্তিশালী অংশ, ব্যক্তি-পর্যায়ে দ্বৈত নাগরিকের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়, এজাতীয় অর্থপাচারের সঙ্গে যুক্ত। বিষয়গুলো বাংলাদেশে (দু’যুগের অধিককাল) আগে আলোচনায় উঠলেও, জনসমক্ষে অধিক স্পষ্টতা পায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদে আকস্মিক পতন ঘটলে (২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধে) এবং ডলার বাজারে অস্থিতিশীলতা দেখা দিলে।
তৃতীয় : নাগরিকত্ব নিয়ে সাধারণ মানুষ খুব কমই ভাবে। এমনকি বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজের মাঝেও এ ব্যাপারে মাথাব্যথা নেই বললেই চলে। তবে বিদেশে নাগরিকত্ব নেওয়ার কারণে সম্পত্তি কেনাবেচা বা অধিক সুপ্রাপ্তির আশায় সঞ্চয়পত্র ক্রয়কালে, অথবা ব্যাংকে আমানত রাখবার প্রয়োজনে, বাংলাদেশের নিবাসী (বাংলাদেশি বা ভিনদেশের নাগরিক) অথবা প্রবাসী বাংলাদেশি (এনআরবি)-এর কোনো একটি পরিচয় বহন করতে হয়। এ ঝামেলা থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিদেশের নাগরিকদের (FCBO – ফরেন সিটিজেনস অফ বাংলাদেশ অরিজিন) প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে বিগত বছরগুলোতে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। সেসব নির্দেশনায় সনদবিহীনভাবে FCBO-দের ভোটার তালিকায় নিবন্ধিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ড সাধারণভাবে দৃষ্টির অন্তরালে ছিল এবং সেসবের আইনানুগ ভিত্তি সম্পর্কে নাগরিক সমাজের পর্যাপ্ত ধারণা ছিল না। অথবা, বলতে আজ দ্বিধা নেই যে, নাগরিক সমাজের ‘সক্রিয়’ (ও তেজস্বী) অংশ নিজেরাই এক্ষেত্রে সুবিধাভোগী। বিষয়গুলো জনসমক্ষে আসে যখন, নানা খসড়ার পথ পেরিয়ে, ২০১৫-১৬ তে (১৯৫১-এর পর প্রথম) খসড়া নাগরিকত্ব আইনের কেবিনেট (মন্ত্রিসভা)-অনুমোদনের সংবাদ প্রকাশ পায়। এ সময় থেকে শুরু হয় দ্বৈত-নাগরিকদের বাংলাদেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অধিকার (?) প্রতিষ্ঠার প্রচারণা। অর্থাৎ, নাগরিকত্ব আইনে, ‘দেশি নাগরিক’ ও ‘বিদেশে নাগরিকত্ব নেওয়া দ্বৈত-নাগরিকদের মাঝে রাজনীতিতে (ও রাষ্ট্র-পরিচালনায়) অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে যেন কোনও পার্থক্য (বৈষম্য) না থাকে সে উদ্দেশ্যে ‘নাগরিক সমাজ’ থেকেই প্রচারণা দেখা যায়! পরে জেনেছি যে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই – কারণ, আমাদের অনেকেই নিজেরা অথবা আমাদের সন্তান ও আত্মীয়স্বজনদের অধিকাংশই অলিখিত বা সনদপ্রাপ্তির দ্বারা দ্বৈত নাগরিক হিসেবে এই সমাজে বিচরণ করছি।
চতুর্থঃ স্থানীয়ভাবে বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিক, প্রবাসী বাংলাদেশি (ভিনদেশে নিবাসী বাংলাদেশি নাগরিক যাদেরকে আমরা এনআরবি আখ্যা দেই), এবং বাংলাদেষি বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিক (যাদের ফরেন সিটিজেনস অব বাংলাদেশ অরিজিন, এফসিবিও আখ্যা দিয়েছি) স্পষ্টতই ভিন্ন জনগোষ্ঠী। এটা অনস্বীকার্য যে, আমাদের অর্থনিতিতে রেমিট্যান্স এনে এনআরবি-এর অবদান অপরিসীম এবং এই কৃতিত্বের সঙ্গে এনআরবি ব্র্যান্ডের মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে দুঃখ হলেও সত্য যে, এফসিবিওরা এই ব্র্যান্ডটি নিজেদের বলে চালিয়ে নিতে সচেষ্ট! সংবাদ মাধ্যমের প্রকাশনা এবং ব্যবসা অঙ্গনে নীতি ও কার্যকলাপ ঘাঁটলে এই প্রবণতা লক্ষ করা যায়, ধীরে ধীরে ২০০৬-০৭ থেকে, এবং ২০১৩-১৪ থেকে দ্রুতগতিতে। এর চরম প্রকাশ মেলে লন্ডনে অবস্থানকালে বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রীকে করা জনৈক ব্রিটিশ নাগরিক (এফসিবিও)-এর প্রশ্নকালীন উক্তিতে। প্রশ্নকারী স্পষ্টতই দেড় কোটি প্রবাসীর (এনবিআর-এর) নাম ভাঙিয়ে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব নেয়া এফসিবিওদের জন্য সুবিধা পাওয়ার নিবেদন করছিলেন! [https://fb.watch/nvvmhgrkye/ দ্রষ্টব্য]
দ্বৈত নাগরিকত্ব কি আসলেই বর্জনীয়?
অনেকেই মনে করেন যে পৃথিবীর বহু দেশে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ রয়েছে। বাস্তবে, ছোট-বড় ২৩১ টি দেশের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায় যে তাদের এক-চতুর্থাংশ দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ দেয়। কিন্তু সংজ্ঞায় রকমভেদ রয়েছে এবং দেশগুলোর মাঝে উদ্দেশ্যের হেরফের দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে অর্থ আকর্ষণ এবং প্রযুক্তি-উন্নত দেশের ক্ষেত্রে, মেধা আকর্ষণ মুখ্য ভূমিকা রাখে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপনিবেশ-কালীন অভিবাসনের ধারাবাহিকতা নীতিনির্ধারণে প্রভাব রেখেছে, বিশেষত, সেসব দেশে যেখানে পরনির্ভরশীলতার আধিক্য রয়ে গেছে। বিস্তারিত বিশ্লেষণে যাওয়ার সুযোগ এখানে নেই। শুধু উল্লেখ করব, দক্ষিণ এশিয়ায় ৮টি দেশের মধ্যে কেবল বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে দ্বৈত নাগরিকের স্বীকৃতি দেখা যায়। পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় দক্ষিণ কোরিয়ায় বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে এই সুযোগ রয়েছে, এবং সেই অঞ্চলের বাকি ২০টা দেশের কেবল একটিতে (ফিলিপাইন্স) দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে মার্কিন সেনার অধীনে যাওয়া ও দীর্ঘকাল সেখানে সেনাঘাঁটির উপস্থিতিতে দুদেশের নাগরিকদের মাঝে যে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং যে মিশ্র নতুন প্রজন্মের আবির্ভাব ফিলিপিনের মাটিতে ঘটে, তাদের পরিচয় নিশ্চিত করতে দ্বৈত নাগরিকত্বের পথ প্রশস্ত করা জরুরি ছিল।
আমাদের প্রতিবেশী ইন্ডিয়াতে একাধিক দেশের নাগরিকত্ব নেওয়া নিষিদ্ধ। তবে সেদেশের এফসিবিওদের ‘পারসন্স অব ইন্ডিয়ান অরিজিন’ আখ্যা দেওয়া হয়, এবং তাদের মধ্যকার আগ্রহী ব্যক্তিরা ‘ইন্ডিয়ার বিদেশি নাগরিক’ (ওসিআই, ওভারসিজ সিটিজেনস অব ইন্ডিয়া) হিসেবে নিবন্ধিত হতে পারেন। ইন্ডিয়াতে যাতায়াতে এবং নির্দিষ্ট কিছু খাতে কাজ করবার বিশেষ সুযোগ ওসিআই-নিবন্ধিত ব্যক্তিদের দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে দ্বৈত নাগরিকত্ব অনুমোদনের ঘটনা ব্যতিক্রমধর্মী। উল্লেখ্য যে দুটো দেশেই এই অনুমোদন-প্রক্রিয়া চালু হয়েছিল অতীতের পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ পৃথক হওয়ার পর। লক্ষণীয় যে, উভয় দেশেই, সামরিক শাসনের সুবাদে মূল আইনের উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুতি ঘটিয়ে বিধির মাধ্যমে দ্বৈত নাগরিকত্বের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৪ই সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে প্রকাশিত এই নিবন্ধের দ্বিতীয় পর্বে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে দ্বৈত নাগরিকত্বের আবির্ভাবের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। পাকিস্তানে দ্বৈত নাগরিকত্বের আগমন ধারায় বাংলাদেশের সঙ্গে অদ্ভুত রকম সাদৃশ্য পাওয়া যায়, যা তৃতীয় পক্ষ ‘রূপকার’-এর উপস্থিতির ইঙ্গিত দেয়। ভবিষ্যতের কোনও গবেষক হয়তো খতিয়ে দেখবেন, নৃগোষ্ঠী (ও জাতীয়তা) কে তুচ্ছ করে ধর্মকেন্দ্রিক রাষ্ট্র গঠনের প্রয়াস পশ্চিমা ডিজাইনে আছে কি না!
দ্বৈত নাগরিকত্বের কিছু আইনি দিক নিম্নে উল্লেখ করে, এই নিবন্ধের বাকি অংশে দ্বৈত নাগরিকত্বের ব্যক্তিচাহিদা এবং স্বদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ দেয়ার ভালোমন্দ প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব। শেষ করব লেখকের নিজস্ব মতপ্রকাশের মাধ্যমে।
দ্বৈত নাগরিকত্বের বিধি কি আইনসম্মত?
প্রথম দুই পর্ব প্রকাশের পর আইনবিষয়ক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপের সুযোগ হয়েছে। সাধারণভাবে বুঝেছি যে, ‘নাগরিকত্ব আইন ১৯৫১’ -এর পর আজ অবধি বাংলাদেশে কোনও নতুন আইন (Law or Act) গৃহীত হয়নি। আইন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন যে, নির্দিষ্ট আইনের মূল ধারা, যেখানে আইনের মুখ্য উদ্দেশ্যের উল্লেখ রয়েছে, তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় এমন কোনও বিধি (Rule) বা নব-সংযোজিত ধারা/উপধারা আইনের দৃষ্টিতেই গ্রহণযোগ্য নয়। যেহেতু ১৯৫১-এর আইনের ১৪ ধারায় দ্বৈত নাগরিকত্ব বা জাতীয়তা নিষিদ্ধ ছিল, তাই পরবর্তীতে বিধির মাধ্যমে ‘দ্বৈত নাগরিকত্ব’ আইনানুগ করা আইনসম্মত কিনা তা খতিয়ে দেখা জরুরি। এ ব্যাপারে আবারও আইন ব্যাখ্যাদানকারী (বিচারিক বিভাগ), আইন প্রয়োগকারী (এনবিআর-জাতীয় সংস্থাসহ) ও আইন প্রণেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
দ্বৈত নাগরিকত্বের লাভ-ক্ষতির বিচার :
দ্বৈত-নাগরিকত্বের আইনানুগ ভিত্তি জোরালো না থাকলেও নতুন যে নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করা হবে সেখানে এই বিষয়ে কাঙ্ক্ষিত নীতিমালা কী হতে পারে, তা ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দের ঊর্ধ্বে গিয়ে স্বদেশ ও সেখানকার জনগোষ্ঠীর কল্যাণের নিরিখে বিচার্য হওয়া কাম্য। তাই, উভয় ব্যক্তি ও সামষ্টিক প্রেক্ষিত থেকে দ্বৈত নাগরিকত্বের ভালোমন্দ দিকগুলো নিম্নে আলোচনা করেছি।
সাদামাটা ভাবনায় ভালোমন্দের বিচার:
বাংলাদেশের শিক্ষিত ও মোটামুটি সচ্ছল সমাজের অধিকাংশ নির্দ্বিধায় বলবেন যে আমরা দ্বিতীয় কোন এক দেশের নাগরিকত্ব পেলে ক্ষতি কি? আমাদের সম্ভাবনার দ্বার প্রসারিত হবে এবং দুর্মূল্যের বাজারে সরকার যখন দেশের অভ্যন্তরে সম্মানজনক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারছে না, নিজ চেষ্টায় অন্য দেশের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করে আয় করা বা ভাতা পাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারলে সমস্যা কোথায়? এসব ইতিবাচক দিকগুলো অর্জনের জন্য অবশ্য দ্বৈত নাগরিক হওয়ার প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন হয় ভিনদেশে নাগরিক হওয়ার সুযোগ। একটি সময় ছিল যখন কিছু বিশেষায়িত পেশার ব্যক্তিদের বিদেশে যাওয়ার অনুমতি সরকার দিত না। কিন্তু আজ, জানামতে, সেই বাধা নেই – এমনকি তার যৌক্তিকতা খোঁজারও প্রচেষ্টা নেই।।
অভিবাসন-সেবা দিতে যেসব প্রতিষ্ঠান বা উকিল/ব্যারিস্টার নেট জগৎজুড়ে আছেন, তারা দ্বৈত নাগরিকত্বের কিছু বিড়ম্বনার কথা উল্লেখ করলেও, অভিবাসন-সেবার বাজারে খদ্দের পাওয়ার উদ্দেশ্যে এদের ওয়েবসাইটে দ্বৈত নাগরিকত্বের পক্ষে গুণগানের একটি লম্বা ফর্দ রয়েছে- নিরাপদ জীবন, স্বাস্থ্যসেবার সুব্যবস্থা, কম পয়সায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ, অধিক বেতন বা মজুরির সম্ভাবনা, ইত্যাদি। সকলেই জানেন, এর প্রতিটি ক্ষেত্রে আকর্ষণের মাত্রা বৃদ্ধি পায় যখন স্বদেশে বিকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। তবে এসবই ব্যক্তি স্বাচ্ছন্দ্যের প্রলোভন, যা উন্নত দেশে নাগরিকত্ব পেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। প্রচারণায় ‘দ্বৈত-নাগরিকত্বের’ উল্লেখ করে এসব প্রাপ্তির কথা উল্লেখ করলেও তা মূলত নতুন কোনও দেশের নাগরিকত্ব নেয়ার আহ্বান।
এটা স্পষ্ট যে ভিনদেশের নাগরিক হওয়ার চাহিদা ও দ্বৈত নাগরিক হওয়ার চাহিদা এক নয়। সহজভাবে দেখলে, একজন বাংলাদেশি দ্বিতীয় কোনও দেশের নাগরিকত্ব নেওয়ার সময় ন্যূনতম তিনটি কারণে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব হারাতে না চাইতে পারেন, অর্থাৎ, দুদেশেরই নাগরিক থাকতে চাইতে পারেন। প্রথমক্ষেত্রে, জীবনের নির্দিষ্ট কোনও পর্বে যেসব তাগিদ থেকে একজন ব্যক্তি ভিনদেশের নাগরিকত্ব নিচ্ছে, তা পরিবর্তনশীল। তাই ভিন্ন এক বয়ষ্কালে স্বদেশে (বাংলাদেশে) কার্যকর নাগরিক অধিকার পাওয়ার ইচ্ছা থাকতে পারে। দ্বিতীয় কারণ, সে অন্য দেশের নাগরিক সুবিধা পাওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব থেকে বাড়তি সুবিধা পেতে আগ্রহী। তৃতীয় কারণের ইঙ্গিত আগেই দিয়েছি। ব্যবসা, কর ফাঁকি বা অর্থ স্থানান্তরের উদ্দেশ্যে অনেক অনাকর্ষণীয় গন্তব্যস্থল (দেশ) কেউ কেউ দ্বিতীয় নাগরিকত্বের জন্য বেছে নেন, যেখানে নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া নাগরিক হওয়ার বাসনা সেসব ব্যক্তিদের নেই। ব্যক্তিপর্যায়ের প্রথম চাহিদা মেটানোর জন্য দ্বৈত নাগরিকত্ব প্রদান আবশ্যিক নয়। বরং ভারতে প্রচলিত পারসন্স অব ইন্ডিয়ান অরিজিন (ইন্ডিয়ার বংশোদ্ভূত ব্যক্তি) এবং অভারসিজ সিটিজেন্স অব ইন্ডিয়া (ইন্ডিয়ান বিদেশি নাগরিক) ধাঁচে নীতি চালু করলে এই চাহিদা পূরণ সম্ভব। শুধু তাই নয়, এই ন্যূনতম সম্মান ও আপ্যায়ন এ দেশের এককালীন নাগরিকদের প্রাপ্য। কিন্তু ব্যক্তিপর্যায়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় চাহিদা পূরণ নৈর্ব্যক্তিক বিচারে দেশের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ার অধিক সম্ভাবনা রয়েছে। তাই দ্বৈত নাগরিকত্ব থেকে বেরিয়ে আসার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে জাতি বা রাষ্ট্র গঠনে এবং স্বদেশের টেকসই উন্নয়নে দ্বৈত নাগরিকত্বের আইনি স্বীকৃতি কী ধরনের প্রভাব রাখে তার ভিন্ন বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
অর্থনীতি ও রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার ওপর প্রভাব:
যারা বাজারব্যবস্থায় আস্থা রাখেন এবং প্রাথমিক অসম সম্পদ বণ্টন গুনতিতে নিতে আগ্রহী নন, তারা শ্রম, অর্থ, প্রযুক্তি ও অন্যান্য সম্পদের অবাধ চলাচলে নিট সুফল পাওয়ার আশা রাখেন। অর্থাৎ, অর্থনীতির ভাষায়, যে (উৎপাদনের) উপাদান যেখানে (ব্যবহারের ফলে) অধিক মূল্য পাবে সেখানে অবাধে যেতে পারলে সকল স্থানের (বা দেশের) আয়ের সমষ্টি, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে, আকারে বৃদ্ধি পাবে। বিশেষায়নের ফলে আঞ্চলিক বৈষম্য-বৃদ্ধির সম্পর্ক আলোচনায় না আনলেও, বাস্তবে দুটো সমস্যা রয়ে যায়। প্রথমত, ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বণ্টনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় অধঃপতন ঠেকানো দুরূহ। দ্বিতীয়ত, শ্রমের আন্তঃদেশীয় চলাচল অবাধ নয়। যদি অবাধ করার আইনি প্রতিবন্ধকতা নাও থাকে, আর্থিক সক্ষমতায় (নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মাঝে) বিশাল বৈষম্য থাকায় অনেকের পক্ষে চলাচলের সে সুযোগ নেওয়া সম্ভব নয়। এসব কারণে সীমিত আন্তঃদেশীয় চলাচলের সুযোগ একটি দেশের অবস্থাপন্নদের বাড়তি সুবিধা দেয়। একইসঙ্গে এটা অনস্বীকার্য যে, এই সুবিধাপ্রাপ্তরা স্বদেশের অগ্রগতি আনতে অবদান রাখতে পারেন, যেমনটি ঘটেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনকালে। [তখন অবশ্য উপনিবেশ-পরবর্তী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেনি এবং সে কারণে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক নাগরিকত্ব ঘিরে কঠোর নিয়ম ছিল না।] তবে বিকল্পটিও ঘটে, যার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, ১৪ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত “শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কেউ বিদেশে, কেউ পলাতক থেকে নিয়ন্ত্রণ করছেন ঢাকার অপরাধজগৎ” শীর্ষক সংবাদে! দ্বৈত নাগরিকদের সাথে ডলার চাহিদা ও হুন্ডি প্রথার বিস্তার পূর্বের লেখায় উল্লেখ থাকায় তার পুনরাবৃত্তি করছি না।
সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সুবিধার্থে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন ও সেসবের সম্ভাব্য উত্তর উল্লেখ করে নিবন্ধটির এই অংশ শেষ করব।
১। যদি পূর্বের নাগরিকত্ব বর্জন করে ভিনদেশে নাগরিকত্ব নেওয়ার অবাধ সুযোগ থাকে, এবং একজন বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিককে (এফসিবিও) সেদেশের নাগরিকত্ব আইনানুগভাবে বর্জন করে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার সুযোগ থাকে, দ্বৈত নাগরিকত্বের বাড়তি সুফল কোথায়?
২। একজন দেশান্তর হলেও কিছু কিছু মানবিক যোগসূত্রতা রয়ে যায়। যেমন, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্তি, স্বদেশের টানে মানুষের জন্য কিছু কাজ করার সুযোগ, ইত্যাদি। আগেই উল্লেখ করেছি যে, এসবই এফসিবিও-দের জন্য আইনানুগভাবে ও স্বচ্ছতার সাথে ব্যবস্থা করা সম্ভব। এরপরও এমন কোন মানবিক দিক কি আছে যা মেটানোর জন্য দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ থাকা উচিত?
৩। একটি ভিনদেশের নাগরিকত্ব নেয়ার অর্থ যে সে সেই দেশের সংবিধান ও সরকারের প্রতি অনুগত থাকবে। এ ব্যাপারে ছেলে-ভোলানো গল্প হাস্যকর হবে। অন্য কোনও এক দেশের প্রজাতুল্য নাগরিককে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে, কিন্তু এদেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অথবা সরকারের রাজনৈতিক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় তাকে দায়িত্ব দেওয়া উচিত কি?
প্রস্তাবনা:
১। নতুন নাগরিক আইন প্রণয়নের পূর্বে ১৯৫১ নাগরিক আইনের মূল মন্ত্র অনুসরণ করা প্রয়োজন। অর্থাৎ, বিধি জারি করে দ্বৈত নাগরিকত্ব দিয়ে যেসব সুবিধা একশ্রেণির মানুষকে আমরা দিচ্ছি, তা প্রাথমিকভাবে রাজনীতিতে বন্ধ করা জরুরি। এক্ষেত্রে প্রথমে নিশ্চিত করা প্রয়োজন যে নির্বাচন কমিশনের কোনও সদস্য যেন অন্য কোনও দেশের সংবিধান ও সরকারের প্রতি আনুগত্যশীল না হন। তাদের সবাইকে লিখিতভাবে অঙ্গীকার করা প্রয়োজন যে তারা অন্য কোনও দেশের নাগরিক নন।
২। নিশ্চিত করা প্রয়োজন যে ভিনদেশের নাগরিক যেন আগত সংসদ নির্বাচনে ভোটার (এবং পদপ্রার্থী) হিসেবে অংশগ্রহণ করতে না পারেন। রাজনৈতিক ক্ষমতার বলয়ে এবং সংবিধান ও নীতিনির্ধারণে ভিনদেশের নাগরিকদের নিয়ে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়।
৩। সরকারে কর্মরত (সামরিক ও বেসামরিক) সকল (দ্বৈত নাগরিক সহ) ভিনদেশের নাগরিকদের ওপর তথ্য সংগ্রহ করে, তাদের সঙ্গে প্রথম ধাপে পরামর্শকভিত্তিক চুক্তি করা যেতে পারে। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে পর-নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে। তবে, তাদের মাঝে কেউ বাইরের নাগরিকত্ব আইনিভাবে পরিত্যাগ করলে, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।
৪। প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভিনদেশের নাগরিকত্ব নেয়া সকল ব্যক্তিকে নিবন্ধিত করা প্রয়োজন। ইদানীংকার ই-পাসপোর্টের ফর্মে শুধু একটি দ্বৈত নাগরিক লেখা ঘরে টিকচিহ্ন দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে, যা অপর্যাপ্ত।
৫। অন্যান্য দেশের নাগরিকত্ব আইন নিয়ে উন্মুক্ত পরিবেশে আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের উপযোগী নাগরিকত্ব আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে হবে।
সাজ্জাদ জহির: অর্থনীতিবিদ; নির্বাহী পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ (ইআরজি)
iii. Anti-Money Laundering/Combating the Financing of Terrorism (AML/CFT)-তে ‘মানি ল্যন্ডারিং’-এর উপযুক্ত বাংলা প্রতিশব্দ জানা নেই। অর্থ-পাচার আখ্যা দিলে অসম্পূর্ণ থাকবে। ‘অর্থ নয়-ছয়’ বললে অস্পষ্টতা রয়ে যাবে। নাইন-ইলেভেন এর পরে এই আইনের প্রবক্তারা সম্ভবত অর্থপ্রবাহের সকল উৎস ও গন্তব্য তাদের তথ্যভান্ডারে সংযোজন করতে সচেষ্ট হয়েছিল। অর্থ স্থানান্তরের সাথে এর সম্পদ-রূপ (আগার) পরিবর্তন জড়িত, বিশেষত, অন্তর্বর্তীকালীন রূপ। তাই, ‘অর্থাগার পরিবর্তন’ শব্দ যোগ করেছি।
vii. এজাতীয় প্রচারণা অবশ্য বেশি লক্ষ করা যায়, বিশেষ ভিসা প্রদানকারী দেশে ‘দ্বিতীয় নাগরিকত্ব’ (সেকেন্ড সিটিজেনশিপ) ‘বাজারজাত’ করার ক্ষেত্রে। নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ স্থানান্তর করে অথবা ন্যূনতম বিনিয়োগের নাম করে এই ব্যবস্থায় দীর্ঘকালীন ভিসা প্রদান করা হয়, যা অনেক দেশে ‘সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচি হিসেবে সুপরিচিত। এ ব্যাপারে ভিন্নভাবে আলোচনার প্রয়োজন, যা এই নিবন্ধে উত্থাপন করা হয়নি। সম্ভবত, নাম না-জানা কিছু দেশে কর এড়ানোর ব্যবস্থা থাকায় এবং কোম্পানির আড়ালে কোম্পানি খুলে দায়বদ্ধতা এড়াতে আগ্রহী ব্যক্তিদের জন্য দ্বৈত নাগরিক প্রথা আকর্ষণীয় হয়েছিল।
ড. সাজ্জাদ জহির : অর্থনীতিবিদ; নির্বাহী পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ
sajjadzohir@gmail.com
[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
Source: https://www.kalbela.com/opinion/sub-editorial/32133
519