চলমান অধঃপতন রোধে রাজনীতির অঙ্গনে সুষ্ঠু মীমাংসা জরুরি
August 3, 2024
সংবিধানে দ্বৈত নাগরিকের বিষয় কীভাবে গণ্য হবে
September 28, 2024

রাষ্ট্র বিনির্মাণে আশু পদক্ষেপের জন্য কয়েকটি প্রস্তাবনা

সমকাল |
০৮ আগস্ট ২০২৪ |
ড. সাজ্জাদ জহির |

ছাত্রসমাজের কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রাথমিক জয় এসেছে ৫ আগস্ট। তবে সমন্বয়কদের বক্তব্যে স্পষ্ট স্বীকৃতি রয়েছে যে উপযুক্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন ও প্রচলিত ধারার রাজনীতির বাইরে গিয়ে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান নতুন করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। পাশাপাশি গতানুগতিক ধারায় দেশ পরিচালনার রাজনীতি পুনঃস্থাপনের উদ্যোগও লক্ষণীয়। এ প্রবণতা ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে। সাধারণ মানুষ যখন আত্মত্যাগের মাধ্যমে বিজয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে, সে সময় পক্ষে-বিপক্ষের কিছু শক্তিধর স্বার্থগোষ্ঠী দরকষাকষি ও সমঝোতা করে পুরোনো ধাঁচে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়।

সমাজে দ্রুত স্থিতি ফিরিয়ে আনার জন্য নির্দিষ্ট আন্দোলনের দ্রুত পরিসমাপ্তি টানার চাপ থাকে। সেই প্রক্রিয়ায় প্রথাগতভাবে যাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল, তারা যেমন সংবিধানের বাধ্যবাধকতার কারণে জড়িত থাকেন, তেমনি দেশি-বিদেশি নানা শক্তি বা স্বার্থ ভবিষ্যৎ রূপরেখাকে প্রভাবান্বিত করার জন্য সক্রিয় ভূমিকায় লিপ্ত হয়। নানা কারণে যাদের রক্তের বিনিময়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়েছে, তারা অন্তর্বর্তীকালীন প্রক্রিয়ায় পর্যাপ্ত ভূমিকা রাখতে পারেন না অথবা সুকৌশলে তাদেরকে প্রক্রিয়ার বাইরে রাখার প্রচেষ্টা থাকে। এই প্রক্রিয়ায় নতুন মোড়কে যে পুরোনো ধাঁচের ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়, তা থেকে জনতার অর্জন দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।

বাঙালির ইতিহাসে এবং পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা কয়েকবার ঘটেছে। সে কারণে সমঝোতা প্রক্রিয়া শুরুর আগে আন্দোলনের অগ্রজদের রাষ্ট্র বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে ন্যূনতম কিছু ‘মৌলিক’ পরিবর্তন চিহ্নিত করা প্রয়োজন। রাষ্ট্র বিনির্মাণের নতুন উদ্যোগে যারা অংশ নেবেন, তাদের নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান রইল।

এক. নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের বর্তমান আইনি ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে আন্দোলনরত ছাত্র-সমন্বয়কদের তাদের পছন্দমতো প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্য নিয়ে নতুন রাজনৈতিক সংগঠন গড়ার সুযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশে নতুন ধারার রাজনীতি চালু করার জন্য এটা অত্যাবশ্যকীয়।

দুই. ১৯৫১ ও পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালের সংবিধান ও নাগরিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে বাংলাদেশ নামে এ ভূখণ্ডের আইন প্রণয়ন ও শাসনভার তাদের হাতেই ন্যস্ত থাকবে, যারা কেবল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকবেন। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে যে কোনো অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থায় কমিটি বা নির্বাচন কমিশন বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনকালে উল্লিখিত নীতি অনুসরণ না করলে কোনো কিছুই পাল্টানো সম্ভব নয়। এই একক বাংলাদেশি নাগরিকত্বের নীতি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনকালে সদস্য ও কর্ণধার নিয়োগের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে হবে।

দ্বিতীয় প্রস্তাবটির আরও ব্যাখ্যা প্রয়োজন হতে পারে। যেমন:
ক. বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কেউ অন্য দেশের নাগরিকত্ব নিলে সে অবশ্যই তার জন্মভূমির সঙ্গে লেনদেনে কিছু বাড়তি সুবিধা পেতে পারে (যেমন সহজ ভিসা, সম্পদ মালিকানায়, কর ইত্যাদি), যা বিশদভাবে পরে নির্ধারণ সম্ভব। কিন্তু ভিনদেশের সংবিধান ও নিরাপত্তার স্বার্থের প্রতি অনুগত এবং অনিবাসী ব্যক্তিদের আইন প্রণয়নে (সংসদ সদস্য), আইন ব্যাখ্যায় (বিচারিক বিভাগ), আইন প্রয়োগে বা আইন ও নিরাপত্তা রক্ষায় (যেমন পুলিশ, র‍্যাব, বর্ডার গার্ড, তিনটি সশস্ত্র বাহিনী) এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে অংশ নেওয়া থেকে বারিত করা জরুরি।
খ. তবে একই সঙ্গে বিদেশে নাগরিকত্ব নেওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের ভিন্নভাবে নিবন্ধীকরণ, তাদের মধ্যকার আগ্রহীদের যাচাই-বাছাই করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিনির্মাণে তাদের সম্পৃক্ত করার সর্বাত্মক চেষ্টা নিতে হবে। এ জন্য বাইরের দেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করে বাংলাদেশে আবাস নেওয়ার আহ্বান জানানো যেতে পারে।

আমি আশা করব, উপরোক্ত দুটো প্রস্তাব (ব্যাখ্যাসহ) অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কার্যক্রম শুরুর গোড়াতেই নীতিগতভাবে গ্রহণ করবে। অন্যথায় ভিনদেশি নাগরিকদের নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র বিনির্মাণ শুরু সম্ভব নয়। দ্বিতীয় নীতিমালা কার্যকর করার জন্য তৃতীয় একটি প্রস্তাব রইল।

তিন. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে (নির্বাচন কমিশন থেকে স্থানান্তরিত) জন্মনিবন্ধন ও নাগরিক নিবন্ধনের তথ্যাগার প্রশাসন ও নাগরিক সমাজের উপযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত কার্যনির্বাহী ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি বা (নবগঠিত) সংস্থার নিয়ন্ত্রণে আনা আবশ্যক। ছোট-বড় সব শহরে, পাড়ায় পাড়ায় এবং শিল্পাঞ্চল বা কলকারখানায় জনসংযোগ সমিতি গড়ে তুলে নাগরিক তালিকা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করা। একই সঙ্গে বেআইনিভাবে বসবাসকারী এবং বেআইনিভাবে কর্মরত বহিরাগতদের তালিকা প্রস্তুত এবং আইন রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় তাদের প্রত্যাগমনের ব্যবস্থা নেওয়া। যদিও নবগঠিত সরকার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিকদের বিভিন্ন খাতে কাজের সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে বলে আশা করি। তবে তার সুষ্ঠু প্রয়োগের জন্য এই শ্রেণির ব্যক্তিদের ও তাদের কর্মাবস্থা সম্পর্কে তথ্য সন্নিবদ্ধ করা প্রয়োজন। এই তথ্যভান্ডারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অভিভাবকত্বে পুরোনো পরামর্শককেন্দ্রিক যে অদৃশ্য রাজত্ব গড়ে উঠেছে, তা নতুন করে ঢেলে সাজানো জরুরি। একই সঙ্গে বিটিআরসিতে (বিধি সংস্থায়) সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধির বাইরে নাগরিক সমাজের কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের নির্বাহী দায়িত্বে সম্পৃক্ত করতে হবে।

পরিশেষে, বিজয়ী তরুণদের প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছা ও শহীদ পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা। সামষ্টিকভাবে তার কার্যকর রূপ দিতে আমার শেষ প্রস্তাব।
চার. ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে এবং শহীদ ও যোদ্ধাদের অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য একটি দিন বেছে নিয়ে তাকে জাতীয় দিবসের মর্যাদা দেওয়া। সেই সঙ্গে শহীদ পরিবারের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে উপযুক্ত সম্মাননার ব্যবস্থা নিতে হবে।
নতুন দিনের সূচনা হোক।

সাজ্জাদ জহির: অর্থনীতিবিদ; নির্বাহী পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ (ইআরজি)

Source: https://samakal.com/opinion/article/249811/%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A7%8D%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A3%E0%A7%87-%E0%A6%86%E0%A6%B6%E0%A7%81-%E0%A6%AA%E0%A6%A6%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A7%87%E0%A6%AA%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%95%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A6%BE

 

552