২০২৫-এর প্রাক-বাজেট আলোচনায় কয়েকটি মন্তব্য ও প্রস্তাব
March 24, 2025

বিরোধের মাত্রা সীমিত রেখে প্রাথমিক সংস্কারের ভাবনা প্রয়োজন

বণিক বার্তা |
সম্পাদকীয় |
১১ এপ্রিল, ২০২৫ |
ড. সাজ্জাদ জহির |

ড. সাজ্জাদ জহির, অলাভজনক বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের (ইআরজি) নির্বাহী পরিচালক। এর আগে তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়া তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন বিশ্বব্যাংক, আইএফসি, আইএফএডি, ইউনিসেফ, এফএও ও ডব্লিউএফপির মতো প্রতিষ্ঠানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করে পিএইচডি করেছেন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোয়। অর্থনীতি ও রাজনীতির সাম্প্রতিক নানা প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন বণিক বার্তায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবিদিন ইব্রাহিম

৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের আগে এবং পরে বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা স্পষ্টভাবে সামনে এসেছে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে ‘নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’-এর দাবি উঠছে। আপনি কীভাবে দেখছেন সামনের দিনগুলোয় এ আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন?

বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের আকাঙ্ক্ষা নতুন কিছু নয়। ঐতিহাসিকভাবেই বিভিন্ন সময়ে সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মাঝে এ আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটেছে। তরুণ বয়সে এ আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা অধিক লক্ষণীয়। সে কারণেই সম্ভবত ইংরেজবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামে, মাস্টারদা সূর্যসেন তার বিপ্লবী সংগঠনে সদস্যভুক্তির তালিকায় ১৬-১৯ বছর বয়সীদের সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তবে অনস্বীকার্য যে সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাগুলো ছাত্র-জনতার মাঝে এ আকাঙ্ক্ষাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। নিকট অতীতে ২০১৮ বা তার কিছুকাল আগে থেকে শুরু হওয়া নানা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত আমরা দেখেছি যে তরুণদের মধ্যে এক ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা কাজ করছে। তাদের রাজনৈতিক মত প্রকাশের ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা বহু দিনের। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তারুণ্যের সেই শক্তি গোপন সংগঠনের বিভ্রান্তিতে হারিয়ে গিয়েছিল। অনেকের মতে, সেই শক্তি পরবর্তী সময়ে জনহিতকর এনজিও কর্মকাণ্ডে সার্থকতা পায়। ১৯৭০-৮০ সময়েও ক্ষণেকের জন্য এমন আকাঙ্ক্ষা সংগঠিতভাবে প্রকাশ পেয়েছিল, রাজনৈতিক পরিসরে যার উত্তরণ ঘটেনি।

আমার মনে হয়, তরুণদের মধ্যকার দেশপ্রেমী অংশ এখনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নিজেদের জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না। সেসব দলে পেশিশক্তিনির্ভর যুবাদের সরব উপস্থিতি রাজনৈতিক উত্তরণে অতিরিক্ত বাধা হয়ে থেকেছে। তাই ২০১৮-২৪ সময়ের তরুণ-যুবারা হয়তো চায় এমন একটি নতুন রাজনৈতিক কাঠামো, যা বিদ্যমান দলগুলোর বাইরে থাকবে, প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গা তৈরি করবে এবং নিজেদের স্বতন্ত্র ক্ষেত্র নিশ্চিত করবে। কিন্তু এখনো এটি পরিপূর্ণভাবে স্পষ্ট নয় যে এ নতুন বন্দোবস্ত কেমন হবে।

আপনি বলছেন, তরুণরা নতুন বন্দোবস্তের কথা ভাবছে, কিন্তু তা এখনো পরিষ্কার নয়। এ বন্দোবস্ত কেমন হতে পারে?

আমি এ প্রশ্নের তিনটি সম্ভাব্য উত্তর দেখি। প্রথমত, তরুণ ও জনসাধারণের একটা অংশ বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়েছে। তারা আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জামায়াতের মতো দলগুলোর ছত্রছায়ায় রাজনীতি করতে চায় না। তারা নিজেদের স্বতন্ত্র একটা অবস্থান গড়ে তুলতে চায়। তবে প্রশ্ন হলো, তারা সেটা কতটা কার্যকরভাবে করতে পারবে?

দ্বিতীয়ত, রাজনীতির বর্তমান রঙ্গমঞ্চে একটি গোষ্ঠী আছে যারা সংস্কারমূলক পরিবর্তনের মাধ্যমে রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলছে। তারা হয়তো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধারণা বা নীতিনির্ধারক কমিশনের মাধ্যমে কিছু কাঠামোগত পরিবর্তনের দিকে যেতে চাইছে। কিন্তু এ ধরনের বন্দোবস্ত কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকলে টেকসই হবে না। যদি রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কাঠামোর পরিবর্তন না হয়, তাহলে এ ধরনের বন্দোবস্ত খুব একটা কার্যকর হবে না। এছাড়া এ গোষ্ঠীর অনেকের বিজাতীয় নাগরিক-অবস্থান, চিরাচরিত সম্মানীভোগী পরামর্শকসম কর্মসংশ্লিষ্টতা হয়তো রাজনৈতিক উত্তরণকালে সাময়িক ভূমিকা রাখতে পারে, তবে খণ্ডকালীন উদ্যোগের কারণে তার স্থায়িত্ব সম্পর্কে শঙ্কা রয়েছে।

উল্লিখিত দুটি উদ্যোগ থেকে হয়তো ভালো কিছু পাওয়ার আশা রয়েছে। তবে আমি তৃতীয় একটি পথের বা উদ্যোগের আবশ্যিকতা অনুভব করি। আমাদের দরকার সামাজিক বন্দোবস্তের নবায়ন। অর্থাৎ রাজনীতির মান উন্নত করতে চাইলে কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃদলীয় সম্পর্কের সীমানা টানলেই চলবে না; তার জন্য সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করা একান্তই জরুরি এবং তা হতে পারে নতুনভাবে সামাজিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

সামাজিক বন্দোবস্ত বলতে আপনি কী বোঝাচ্ছেন?

আমাদের সমাজ বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত। এসবের প্রকাশ ঘটে আত্মপরিচয় প্রকাশকালে। আঞ্চলিকতার বাইরে বাংলাদেশের অধিবাসীদের কেউ বাঙালি মুসলমান, আবার কেউ-বা ধর্মীয় সংখ্যালঘু পরিচয়ে বাঙালি হিন্দু, খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। সমতল ও পাহাড়ি অধিবাসীদের পার্থক্যের সঙ্গে বহুলাংশে মিশে আছে বাঙালি ও বেশ কয়েকটি জনসংখ্যায় ক্ষুদ্র ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তা। এমনকি সমতলেও সংকর বাঙালির বাইরে একাধিক ক্ষুদ্র জাতিসত্তা রয়েছে। শহর-গ্রাম, উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্ত বা শ্রেণীবিভাজনের বাইরেও প্রতিটি সম্প্রদায়ে ভিন্ন আঙ্গিকে অধিক বিভাজন সম্ভব। এসবের বাইরে বিশ্বায়ন ও ভিন দেশে নাগরিকত্ব নেয়া নতুন গোষ্ঠীর উদ্ভবের ফলে বৈশ্বিক শাসন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা দৃশ্যমান। তাদের উদ্ভব ও বিকাশ বহু বছর ধরে চলমান এবং জুলাই-পরবর্তী সরকার গঠনে সেই ‘প্রবাসী’ গোষ্ঠীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিচারে এসব গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠীগুলোকে অর্থবহভাবে চিহ্নিত না করলে এবং তাদের মধ্যে ‘সমঝোতা’ প্রতিষ্ঠা না করলে যেকোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তই ক্ষণস্থায়ী হবে।

আমরা অতীতে দেখেছি, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চুক্তি হয়েছে, কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। কারণ সামাজিক স্তরে যে অসামঞ্জস্য ও বৈষম্য আছে তা দূর হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের মধ্যকার সমঝোতা ভাগবাটোয়ারার সমঝোতায় পর্যবসিত হয়েছে, যা দুঃখজনকভাবে অনেক সময় বাইরের শক্তির মধ্যস্থতায় সম্পন্ন করা হয়েছে। তাই রাজনৈতিক পরিবর্তনের পাশাপাশি সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অর্থবহ সমঝোতা আনতে হবে।

তাহলে আপনি কি মনে করেন, তরুণদের এ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা রাতারাতি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়?

হ্যাঁ, এটা রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়। কিন্তু তরুণদের যে ভিন্ন ক্ষেত্র (বা স্পেস) তৈরির চেষ্টা, তা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ও সমর্থনের দাবি রাখে। এটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া, তবে দীর্ঘমেয়াদে রাজনীতির গুণগত মান উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য এটি অপরিহার্য।

তবে তরুণরা যদি প্রাক-পরিকল্পনা ছাড়া কেবল পুরনো রাজনৈতিক কাঠামোর ভেতরে নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে চায়, তাহলে তা স্থায়ী হবে না। আবার যদি শুধু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব-কাঠামোর মধ্যে পরিবর্তন আনার চেষ্টা হয়, তাহলে সে উদ্যোগ টেকসই হবে না। আমার মতে, সামাজিক বন্দোবস্তের রূপরেখা প্রণয়ন ও এ ব্যাপারে দল-মত নির্বিশেষে অধিকাংশের মাঝে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক কাঠামোর সংস্কার ও পুনর্গঠন এবং তরুণদের চাঁদাবাজমুক্ত সক্রিয় অংশগ্রহণ—এ তিন উপাদান একসঙ্গে কাজ করলে তবেই একটি টেকসই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি হতে পারে।

চাঁদাবাজমুক্ত বিশেষণের ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন। কোনো দলকে দোষ না দিয়ে সবার উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদনমুখী কর্মসংস্থান বৃদ্ধি না পাওয়ায় এবং দীর্ঘকাল দাসত্বমূলক গোষ্ঠীশাসন চালু থাকায় সংঘবদ্ধ পেশিশক্তির উত্থান ও বিস্তৃতি ঘটেছে। এটা একদিকে রাস্তাঘাটে, বাজারে ও টেন্ডারে (ঠিকাদারিতে) চাঁদাবাজি রূপে প্রকাশ পেয়েছে; এবং পাশাপাশি বিগত শাসনকালে প্রশাসনে আত্তীকৃত অযোগ্য ব্যক্তিদের সংগঠিত দুর্নীতিকে স্থায়িত্ব দিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ দেখে মনে হয়েছে যে তারা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ এনে দেশজ উৎপাদন ও রফতানিতে অধিক আগ্রহী, যা সবক্ষেত্রে স্থানীয়দের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারবে না। একই সঙ্গে স্বনিয়োজিত ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডের প্রতি অপ্রত্যাশিত নেতিবাচক নীতি প্রকাশ পায় ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহারে এবং ভোক্তা-অধিকার দপ্তরের স্থানীয় (পো­শাক) উৎপাদনবিরোধী অত্যুৎসাহী কর্মতৎপরতায়! এ বাস্তবতায় স্থানীয় পুঁজির ধারক-বাহকদের সক্রিয় সহায়তা না পেলে অথবা স্থানীয় কর্মসংস্থানে আগ্রাসী নীতি না নিলে ‘চাঁদাবাজমুক্ত’ অথবা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল তরুণ পাওয়া দুষ্কর হবে।

সংবিধানে সামাজিক বন্দোবস্তের প্রস্তাব কীভাবে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে?

অনেকের মতে, সামাজিক বন্দোবস্তে আমূল পরিবর্তন আনার জন্য তড়িৎগতিতে যে বৈপ্লবিক পদক্ষেপ দরকার ছিল, সংগ্রামী ছাত্র-জনতার সে প্রস্তুতি ছিল না। তাই সংঘাতের মাত্রা সীমিত রেখে প্রাথমিক সংস্কারের ভাবনা করা প্রয়োজন। সামাজিক বন্দোবস্ত সম্পর্কে আইনবিশারদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে বলে জানি। দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে গবেষণাকালে আমি এ উপমহাদেশের সংবিধানগুলো স্বল্পবিস্তর ঘেঁটেছি। তথ্য থেকে প্রাপ্ত ধারণার ভিত্তিতে প্রশ্নটির উত্তর দিতে চেষ্টা করব।

পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের সংবিধানের শেকড়, আমার জানামতে, ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ সংসদে গৃহীত গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্টে, যার বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয় হয় ১৯৩৭ সালে। চল্লিশের দশকে নানা বিতর্কের পথ পেরিয়ে ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধান এবং তদানীন্তন পাকিস্তানের ১৯৫১ সালের নাগরিকত্ব আইন ও ১৯৫৬ সালের সংবিধান নিজ নিজ সংসদে গৃহীত হয়। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের ১৯৭২-এর সংবিধান বহুলাংশে আগের ধারা বজায় রেখে রচিত হয়। ভারত ও পাকিস্তানের উভয় সংবিধানে দ্বিতীয় খণ্ডটি ছিল ‘নাগরিকত্ব’ নিয়ে, যা ভারতের সংবিধানে থাকলেও বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী পাকিস্তানের উভয় সংবিধান থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে দুটো সংবিধানেই সেই জায়গা নিয়েছে রাষ্ট্রীয় নীতিসংক্রান্ত বিষয়াদি!

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে অঙ্গীভূত থাকাকালে আইন প্রণয়নের এখতিয়ার ছিল কেবল ব্রিটিশ সংসদের; উপমহাদেশের কোনো সংস্থার নয়। সাম্রাজ্যের অধিকারী শাসকের সঙ্গে উপনিবেশের সম্পর্কের প্রতিফলন দেখা যায় উভয় ভারত ও পাকিস্তানে প্রবর্তিত কেন্দ্র ও প্রদেশের (রাজ্যের) মধ্যকার সাংবিধানিক ও আইনি সম্পর্কে। অনেক ক্ষেত্রে প্রদেশের আড়ালে ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তা মিশে থাকায় এবং ক্ষুদ্রতর জাতিগোষ্ঠীর সোচ্চার উপস্থিতি না থাকায়, পাকিস্তানের সংবিধানে সামাজিক বন্দোবস্তের বিশদতা লক্ষ করা যায় না। ভারতের ক্ষেত্রে সে কথা সত্য ছিল না। তাই অনেক রাজ্যে একাধিক তফসিলভুক্ত জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করতে হয়েছিল এবং সংবিধানে সেসব জনগোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব লিপিবদ্ধ করতে হয়েছিল। অন্তরালে দুই দেশের ক্ষেত্রেই আপাত যুক্তরাষ্ট্রীয় (ফেডারেল) ব্যবস্থার আড়ালে মুখ্য স্বার্থের কর্তৃত্ব থাকায় কার্যত একাধিক জাতিসত্তার ভেতরকার সামাজিক চুক্তিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। বললে হয়তো ভুল হবে না যে প্রাক-বৈদিক জাতিগোষ্ঠী, যাদের মনুস্মৃতিতে সমাজের নিম্নবর্গে স্থান দেয়া হয়েছিল, সেইসব (অচ্ছুৎ) ‘দলিত’দের রাষ্ট্রকাঠামোয় সম্পৃক্ত করার জন্য আম্বেদকারের ভূমিকা অনেকেই স্মরণ করেন। ভালো-মন্দের বিচার না করে এটাকে সামাজিক চুক্তির প্রত্যক্ষ উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন উপজাতিতে লিপিবদ্ধ করে তাদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক আইন ও শর্তের বাঁধনে আনাকে চাপিয়ে দেয়া একপেশে ‘সামাজিক চুক্তি’ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। একই অভিমত ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের জন্য প্রযোজ্য। সম্ভবত একপেশে হওয়ার কারণে এ-জাতীয় সামাজিক চুক্তি ভঙ্গুর হতে দেখা যায়।

১৯৫০ সালের ভারতের সংবিধান ও পাকিস্তানের (খসড়া) সংবিধানের গভীরে গেলে দেখা যায় যে কেন্দ্রের কর্তৃত্ব স্থাপন ও বিস্তারে ভাষাকে এক মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা শুরু থেকেই ছিল, যা বিদায়ী উপনিবেশবাদী শক্তির সঙ্গে উপমহাদেশের বিশেষ গোষ্ঠীর আঁতাতের (বৈশ্বিক রাষ্ট্রের সামাজিক চুক্তির?) ফল হিসেবে গণ্য করা যায়। একই খাড়িবলি ভাষা, যা দুটো ভিন্ন লিপিতে প্রকাশ পায়, সেই হিন্দি (সংস্কৃত লিপি) ও উর্দু (ফার্সি লিপি), পৃথকভাবে দুই দেশের কেন্দ্রীয় (ইউনিয়নের বা দাপ্তরিক বা রাষ্ট্র) ভাষা হিসেবে সংবিধানে গণ্য করা হয়। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন এক অর্থে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রথম বিজয়। সম্ভবত সে কারণে ১৯৫৬ সালে গৃহীত পাকিস্তানের সংবিধানে ভাষার বিষয়টি দমিত থেকেছে, অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দুর প্রতাপ থাকলেও পূর্বে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়। অথচ ভারতের সংবিধানে আঞ্চলিক ভাষার স্বীকৃতি দিলেও নির্দিষ্ট সময়সীমার মাঝে হিন্দি ভাষার প্রসার রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক বিবেচনা করা হয়। ১৫ বছরের প্রাথমিক সময়সীমা ১৯৬২-৬৫ সালের দিকে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এ ভাষাভিত্তিক সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে দক্ষিণ ভারতে ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য উর্দুবিরোধী আন্দোলন থেকে সেটা কোনো অংশে কম ছিল না। আমার জানামতে, হিন্দিকে সব রাজ্যে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার সময়সীমা কয়েকবার পেছাতে হয়েছে এবং ইদানীংকালে সেই বিরোধ আবারো দৃশ্যমান।

স্বীকার করতে হবে যে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষার উৎকৃষ্ট সাধনে প্রয়াস থেকেছে। এক্ষেত্রে যেসব ভাষার নিজস্ব লিপি নেই, তা প্রকাশে বাংলা লিপিকে, ইংরেজি ও হিন্দি লিপির সঙ্গে পাল্লা দিতে হচ্ছে। এসব নৃ-গোষ্ঠীর সঙ্গে টেকসই সামাজিক চুক্তি স্থাপনের জন্য ভাষার বিষয়টি মীমাংসা হওয়া জরুরি। অর্থাৎ যেসব ক্ষুদ্র নৃ-ভাষাগোষ্ঠীর নিজস্ব লিপি নেই, উভয় বাংলা লিপি ও ভাষায় প্রতিনিয়ত উৎকর্ষিত করে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-ভাষাগোষ্ঠীর লোকেরা সম্ভবত উপলব্ধি করবেন যে বাংলার ছত্রছায়ায় তাদের ভাষার যে বিকাশ সম্ভব, তা পশ্চিম থেকে আসা হিন্দির নিয়ন্ত্রণে ঘটবে না।

পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তির দ্বিতীয় বড় হাতিয়ার ছিল ধর্ম। ইংরেজরা কেবল হিন্দু, মুসলমান ও শিখ ধর্মকে স্বীকৃতি দিত এবং উপমহাদেশের সব জনগোষ্ঠীকে এ তিন খোপে ফেলতে সচেষ্ট ছিল। এখন সময় এসেছে এ ভূখণ্ডের সুদীর্ঘ মানব ধর্মের ইতিহাস ও কৃষ্টিকে স্বীকৃতি দেয়া, এ মাটির সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও মতুয়া সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা অনুধাবন করা এবং হিন্দু ধর্মের মোড়কে ব্রাহ্মণবাদ প্রতিষ্ঠা না হতে দিয়ে সুদূর অতীতের তান্ত্রিকতা ও প্রকৃতি পূজার বিবর্তনকে স্বীকৃতি দেয়া। দর্শন ও জ্ঞানচর্চার বাইরে হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ এ জনপদের জন্য কতখানি আত্মঘাতী, ইতিহাসে তার অঢেল সাক্ষ্য রয়েছে। এত সংকরতার মাঝে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও ধর্মান্তর এ সমাজকে নানাভাবে উৎকৃষ্ট করেছে, যার স্বীকৃতি বাবা লোকনাথের জীবন কাহিনীতেও পাওয়া যায়। বহু সহস্রাব্দী ধরে পূর্ব ও পশ্চিম থেকে এ জনপদে মানুষ এসেছে। তবে প্রাচীন বাংলার হারিয়ে যাওয়া বা চর্যাপদের লিপি, ব্রাহ্মণবাদ প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট সেন রাজাদের অত্যাচার এড়িয়ে বলিষ্ঠভাবে প্রতিষ্ঠা পায় সুলতানি আমলে। অথচ এ দেশের ইতিহাস পাঠ্যপুস্তক থেকে বেমালুম গায়েব করে দেয়ার চেষ্টা চলেছিল বিগত সরকারের আমলে। বাইরের স্বার্থে আমাদের মাঝে অনৈক্য সৃষ্টির উদ্যোগকে প্রতিহত করতে হলে বর্তমান বাস্তবতায় ধর্মীয় সংখ্যাগুরুদের ধর্মীয় সহাবস্থানের টেকসই সামাজিক চুক্তি রচনায় উদ্যোগ নিতে হবে।

নৃ-গোষ্ঠী, ভাষা ও ধর্মের বাইরে বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্নের পথে এগোতে হলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর ভেতর বন্দোবস্ত স্থাপন প্রয়োজন। ২০২৪ সালের ৩০ অক্টোবর বণিক বার্তায় প্রকাশিত ‘জাতিসত্তা থেকে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র ও জাতি গঠন’ শীর্ষক নিবন্ধে আমি তার আংশিক বিবরণ দিয়েছি। আশা করব, তরুণরা একদিকে যেমন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাবেন, তেমনি তারা এ জনপদের নৃ-ভাষাগোষ্ঠীর বৈচিত্র্য, ধর্ম ও দর্শনের নানামুখিতা এবং সেসব ধারার সহাবস্থানের ইতিহাসকে গর্বের সঙ্গে নিজেদের সম্পদ ও ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেবে।

Source: https://www.bonikbarta.com/editorial/L5nIJX3iiGAHGrBI

65