ড. সাজ্জাদ জহির |
বণিক বার্তা |
নভেম্বর ০৩, ২০২২ |
পটভূমি ও সংক্ষিপ্তসার
বিশ্বায়ন এবং ঘরে-বাইরে গৃহীত অভিবাসন নীতির ফলে বিগত দশকগুলোয় এক সময়কার উপনিবেশ (দক্ষিণ গোলার্ধ) থেকে উপনিবেশকারী (উত্তর গোলার্ধের) দেশগুলোয় মানুষের অভিবাসন বেড়েছে, এমনকি অভিবাসনের চরিত্রেও বদল ঘটেছে। গত শতকের সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকে উত্তরের দেশগুলোয় অভিবাসিতরা স্থায়ীভাবে বসত গেড়েছিল। দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে দেশে থাকা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দৈনন্দিন যোগাযোগ রাখা সম্ভব ছিল না। প্রযুক্তিনির্ভর তথ্যপ্রবাহের (ডিজিটাল ব্যবস্থার) ফলে সে রীতি পুরোপুরি বদলে গিয়েছে। দৈনিক ফোনকল ও ভিডিওকলের মাধ্যমে এখন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা সম্ভব। একই সুবাদে নিজস্ব সম্পদ বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের খোঁজখবর নেয়া এবং আর্থিক খাতে বিনিয়োগ ও তদারকি সহজ হয়েছে। আগের অভিবাসনের ক্ষেত্রে যে জ্ঞান ও সংশ্লিষ্ট দক্ষতার পাচার হতো (মেধা বা ব্রেনড্রেইন), তা এখনো অব্যাহত আছে। তবে স্থায়ী অভিবাসন খাতে বিগত বছরগুলোয় আরো দুটো উপসর্গ লক্ষ করেছি। উত্তরের দেশে আবাস নিলেও নতুন অভিবাসীদের অনেকেই পূর্বপুরুষের দেশে কর্মসংস্থানকে আকর্ষণীয় মনে করে। অতীত অভিবাসীদের দ্বিতীয় প্রজন্মের মাঝেও এ প্রবণতা লক্ষণীয়। এমনকি সত্তর-আশির দশকের প্রথম প্রজন্ম অবসর-পরবর্তী উপার্জনের প্রত্যাশায় অথবা শেকড়ের সমৃদ্ধিতে অবদান রাখার লক্ষ্যে দেশে ফেরেন। দক্ষিণ গোলার্ধে আরো অনেকেই আছেন যারা স্বদেশে বাস করেন, কিন্তু তাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন বড় বড় ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, রাজনীতিবিদ এবং প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। স্থায়ীভাবে অভিবাসিত সবাই উল্লিখিত উপার্জনকেন্দ্রিক শেকড়সংযোগে জড়িত নয়। তবে এশিয়া ও আফ্রিকার আগের উপনিবেশগুলোয় উভয় উত্তর ও দক্ষিণের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা সুবিধাভোগীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান এবং তাদের অনেকে দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে চালিকার ভূমিকায় অবস্থান নিয়েছে। বললে অত্যুক্তি হবে না যে, আঞ্চলিক ও বিশ্বপরিসরের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় এ প্রক্রিয়া দীর্ঘকাল চলমান। তবে সম্পদ সৃষ্টি ও তার স্থানান্তরে মুদ্রা ও সার্বিক অর্থব্যবস্থার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় এ বিশেষ মনুষ্য গোষ্ঠীর আচরণবিধি অনুধাবন দক্ষিণের জন্য জরুরি। অনুতাপের বিষয় এই যে ‘বিজাতীয়’ স্বার্থ যখন দক্ষিণের নির্দিষ্ট দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা হরণ করে, উত্তরের অভিবাসিতদের স্বেচ্ছাচারিতা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় এবং তা থেকে মুক্তি পাওয়ার সহজ কোনো পথ থাকে না।
আইনি ব্যাখ্যায় না গিয়ে এ নিবন্ধে দ্বৈত নাগরিকত্বের (ডিসি বা ডুয়াল সিটিজেন) সহজ সংজ্ঞা দিয়েছি। উত্তর গোলার্ধে স্থায়ী অভিবাসিতদের মধ্যকার যেসব উল্লিখিত মানবগোষ্ঠী, প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে তাদের পূর্বপরিচিতির (কান্ট্রি অব অরিজিন) দেশের নাগরিকত্বের সুবিধা ভোগ করে, তাদের সবাইকে এ নিবন্ধে দ্বৈত নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করেছি। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ডিসি গোষ্ঠী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বিদেশী নাগরিকদের (ফরেন সিটিজেনস অব বাংলাদেশ অরিজিন) একটি অংশ বিশেষ। কারণ অনেকে স্থায়ী অভিবাসন নেয়ার পর ওই জাতীয় সুবিধা নিতে সচেষ্ট হননি। যাদের ডিসি বলে সম্বোধন করছি তাদের মাঝে প্রকৃত নন রেসিডেন্ট বাংলাদেশীরা (এনআরবি) অন্তর্ভুক্ত নয়। যেসব বাংলাদেশী নাগরিক কাজের জন্য বা অন্য কোনো কারণে অস্থায়ীভাবে বিদেশে আবাস (রেসিডেন্সি) নেন, তারাই আইনানুগভাবে প্রকৃত এনআরবি। সুদীর্ঘকাল বিদেশে শ্রম বিক্রি করে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে এনআরবি পরিচয়ের একটি ব্র্যান্ডমূল্য গড়ে উঠেছিল, যা গত সাত-আট বছরে ডিসি সম্প্রদায়ের লোকেরা রীতিমতো ছিনতাই করে নিয়েছে। বিশ্বব্যবস্থাপনায় ডিসি গোষ্ঠীকে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে দক্ষিণের ওপর উত্তরের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য আরো পাকাপোক্ত করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, এ নতুন ধরনের শাসন ব্যবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ একটা উত্তম ক্ষেত্র। তাই আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণে ডিসি নামক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি জরুরি, যা নতুন প্রেক্ষাপটে চলমান ঘটনাপ্রবাহ আরো ভালোভাবে বোঝার সুযোগ দেবে।
ডিসির গুরুত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতি ও অর্থনীতির অঙ্গনে আমরা অনেক নতুন ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হতে পারি, যা আগে ভাবতে পারিনি। সম্পদের (আর্থিক ও স্থাবর সম্পত্তি) সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য ভালো নীতি ও নিয়ন্ত্রণবিধি প্রণয়নে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও উপদেষ্টাদের ডিসির চরিত্র (বৈশিষ্ট্যগুলো) বোঝা জরুরি। আন্তঃদেশীয় সম্পদপ্রবাহের ক্ষেত্রে এ বক্তব্য অধিকতর প্রযোজ্য। এ লেখায় ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, ডলারের বিপরীতে টাকার স্বল্পমেয়াদি অস্থিরতা ব্যাখ্যায় মুদ্রা ও সম্পদবাজারে ডিসি (কিংবা ডিসি হতে আকাঙ্ক্ষী) সম্প্রদায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আরো বলা হয়েছে যে, ডিসি সম্প্রদায়ের বর্ধিত প্রভাবের ফলে বৈদেশিক ঋণের পক্ষে বাংলাদেশের নীতির পক্ষপাত বাড়তে পারে এবং ভালো-মন্দ বিচার না করেই ঋণের সঙ্গে যুক্ত শর্তাবলি মেনে নেয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে। শেষের দিকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ডিসির (এবং এফসিবিওর) কার্যপ্রভাব গুনতিতে এনে যথাযথ শ্রেণীবিভাজন করা প্রয়োজন। মৌলিক বিশ্লেষণ-ধারণা হিসেবে ডিসি (দ্বৈত নাগরিক) কথাটি গ্রহণযোগ্যতা পেলেই তার অর্থবহ শ্রেণীবিভাজনের (ক্যাটাগরাইজেশন) আলোচনা শুরু হতে পারে। যেহেতু অনেক ডিসিরই নিজেদের উৎস ভূমির প্রতি অবদান রাখার ইচ্ছা ও সুযোগ আছে, সেহেতু এ লেখায় স্বদেশ ও সেখানে বসবাসরত জনগণের উন্নতির জন্য ডিসি সম্প্রদায়ের সঙ্গে নতুন ধরনের ‘সামাজিক চুক্তি’ করার লক্ষ্যে আলোচনা শুরু করতে স্বদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
দ্বৈত নাগরিকত্বের উদ্ভব ও ডিসিনির্ভর উত্তর–নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনা
নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী, অতিরিক্ত কর-ভোগান্তি এড়ানোর উদ্দেশ্যে দ্বৈত কর চুক্তি সম্পাদন, উত্তরের দেশগুলোর অভিবাসন নীতি এবং দক্ষিণের দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে (উত্তরে) স্থায়ী অভিবাসিতদের উত্থান একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে হয়। এসব ঘটনা সম্মিলিতভাবে, নামে বা বেনামে, দ্বৈত নাগরিকত্বের উদ্ভব ঘটিয়েছে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত রিদওয়ানুল হকের ‘রিপোর্ট অন সিটিজেনশিপ ল: বাংলাদেশ’ শীর্ষক নিবন্ধটি নাগরিকত্ব আইনের ঐতিহাসিক বিবর্তনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলোকপাত করে। এতে বলা হয় যে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে প্রাপ্ত আইনে পরিবর্তন বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে প্রায় সমতালে এসেছে। সাধারণভাবে আইনের এক ব্যাখ্যায়, এসব দেশের নাগরিকরা দ্বিতীয় কোনো দেশের নাগরিক হওয়ার কথা নয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে উত্তরের দেশে স্থায়ী অভিবাসন বৃদ্ধি পাওয়ায় দক্ষিণের দেশে নাগরিক আইনে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে। বিশেষ করে ভারতীয় বংশোদ্ভূত অভিবাসী জনগোষ্ঠী থেকে চাপ সৃষ্টির ফলে এ উপমহাদেশে ‘দ্বৈত নাগরিকত্বের’ ধারণা দানা বাঁধে এবং অনেকের মতে, এর পেছনে পশ্চিমা (উত্তরের) দেশগুলোর পরোক্ষ মদদ ছিল। ‘ওভারসিজ সিটিজেনস অব ইন্ডিয়া (ওসিআই) নামে নতুন একটা তকমা (ক্যাটাগরি) প্রবর্তনের মাধ্যমে ভারত ২০০৫ সালে প্রথম এ-সংক্রান্ত পদক্ষেপ নেয়; যেটিকে অনেক ভাষ্যকারই ডিসি হিসেবে বিবেচনা করেন, যদিও আইনগতভাবে দ্বৈত নাগরিকত্ব সে দেশে স্বীকৃত নয়। তাই নিবন্ধন, বিশেষ ভিসা প্রদান (অথবা নো ভিসা রিকোয়ার্ড), ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেনের নীতিমালা, অর্থ বিনিয়োগে, ও রেসিডেন্সি (আবাস)-ভিত্তিক ব্যক্তি আয়কর নিরূপণের নীতিমালার মাধ্যমে অনেক নাগরিক সুবিধা দেশান্তরিত অভিবাসীদের দেয়া হয়। ২০০৮ সালের মে মাসে বাংলাদেশ দ্বৈত নাগরিকত্ব প্রবর্তন করেছে, তবে সেই নির্দেশ যথেষ্টভাবে স্বচ্ছ বা স্পষ্ট নয়। মজার বিষয় হলো, উপমহাদেশের দেশগুলো কেবল উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়াসহ গুটিকতক দেশের অভিবাসীদের দ্বৈত নাগরিকত্বের নামে বিশেষ সুবিধা দেয়। (পরবর্তী সময়ে অবশ্য সুফলভোগী গোষ্ঠীর পরিধি কিছু ব্যতিক্রমসহ তিন দেশই বাড়িয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর ক্ষেত্রে ভারতীয় অভিবাসন নীতি বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে, যা আঞ্চলিক রাজনীতির সঙ্গে গ্রথিত। সে আলোচনা থেকে আমি বিরত থেকেছি।)
পৃথিবীর প্রায় অর্ধ শতাংশ দেশে দ্বৈত নাগরিকত্বের চল আছে। কিন্তু বিষয়টি মূলত বিনিয়োগ পরিবেশের আলোচনায় এবং ভিসার বাধা হ্রাস করে বিত্তবানদের অবাধ চলাচলের পরিপ্রেক্ষিতে সীমাবদ্ধ থেকেছে। উত্তরের নিয়ন্ত্রণে বিশ্বব্যবস্থাপনায় যে এ সম্প্রদায়ের উল্লেখজনক ভূমিকা রয়েছে, তা অনেকাংশেই মুক্ত আলোচনার বাইরে থেকে গেছে। আগেই উল্লেখ করেছি যে, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কনভেনশনের আঙ্গিকে নাগরিকত্ব আইন ও অভিবাসন নীতির সংশোধনী এবং দ্বিপক্ষীয় করচুক্তি ও সমধর্মী পশ্চিমা উদ্যোগ ইঙ্গিত দেয় যে, ডিসি উত্থানের পেছনে উত্তরের দেশগুলোর স্বার্থ জড়িত। এটা অনুমেয় যে, বিশ্বপরিসরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় এই ডিসি সম্প্রদায়ের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই এত আয়োজন। দক্ষিণের দেশে এ প্রস্তাবনার পক্ষে অনেক তথ্য দেয়া সম্ভব। এ ধারণা আরো জোরালো হয় যখন দেখি যে, অন্য অনেক উন্নয়নশীল দেশে প্রায় একই সময়ে এ-জাতীয় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যেমন ফিলিপাইনসে ২০০৩ সালে নাগরিকত্ব রক্ষা ও পুনঃঅধিগ্রহণ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এককালীন ফিলিপিনো নাগরিকদের মাঝে যারা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন, তাদের দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ দেয়া হয়। আরো উল্লেখ্য, কর সাশ্রয়ে সুযোগসন্ধানী পুঁজির (বহিঃ) প্রবাহ (যা নোম্যাড ক্যাপিটাল নামে পরিচিতি পেয়েছে) নিয়ে শঙ্কা থাকা সত্ত্বেও এবং খোদ যুক্তরাষ্ট্রে দুজন কংগ্রেসম্যান মাত্র কয়েক মাস আগে সে দেশের নাগরিকদের জন্য দ্বৈত নাগরিকত্ব বাতিলের একটি বিল ঊত্থাপন করলেও এক্ষেত্রে দক্ষিণের দেশের জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। যতদিন এ ধরনের সম্পর্ক থেকে নিট লাভ-প্রাপ্তি থাকবে, বাতিল করার হুঁশিয়ারি সম্ভবত ভীতি প্রদর্শনের হাতিয়ার রয়ে যাবে।
দ্বৈত নাগরিক আইনানুগ রূপ পায় যদি দুদেশের মাঝে সমঝোতা থাকে। কিন্তু কাগজে-কলমে তার প্রকাশ ও বাস্তবের চর্চায় ফারাক থাকে, যার বিবর্তন ভিন্ন গবেষণার বিষয় এবং যা দুদেশের আপেক্ষিক ক্ষমতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত। বিশ্বব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে দ্বৈত নাগরিক প্রথা চালু করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কয়েকটি নির্দিষ্ট হাতিয়ার ব্যবহারের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এদের মাঝে ব্যক্তি আয়কর এড়ানোর সুযোগ, দুই রাষ্ট্রের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও ব্যক্তি দ্বৈত নাগরিকদের অতিরিক্ত সুবিধা আনে। আয়কর নিরূপণের ক্ষেত্রে কর বিভাগ প্রায়ই রেসিডেন্সি স্ট্যাটাসে জোর দেয়। সরলীকৃত এক পদ্ধতিতে, ছয় মাসের অধিককাল যদি কেউ এক দেশে অবস্থান করে তাকে সে দেশের আবাসী (রেসিডেন্ট) গণ্য করা হয়। দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোর কর ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও তা নীতি ও কার্যনির্ধারণের সঙ্গে যুক্ত করায় ঘাটতি থাকায় কর ফাঁকির সুযোগ রয়ে যায়।
অথচ দক্ষিণ থেকে তথ্যের বহিঃপ্রবাহে ঘাটতি নেই। ডিসি ও ডিসিপ্রত্যাশীদের ওপর নির্ভর করে দক্ষিণের দেশগুলোয় গড়ে ওঠা পরিচালন কাঠামো এবং বিভিন্ন বহুপক্ষীয় চুক্তির সহায়তায় প্রযুক্তিগতভাবে প্রাগ্রসর দেশগুলোয় (উত্তরের) সরকার ও সরকারি এজেন্সিগুলোর জন্য দক্ষিণ থেকে তথ্যপ্রাপ্তি সুগম হয়েছে। সেসব তথ্য ব্যবহার করে তারা নিজ স্বার্থের পক্ষে নীতিনির্ধারণ করতে সক্ষম হচ্ছেন। অর্থ পাচারবিরোধী বা সন্ত্রাসবিরোধী অর্থায়ন বন্ধে গৃহীত কর্মসূচি (এএমএল/সিএফটি) দক্ষিণের দেশের ওপর চাপিয়ে দিয়ে এ তথ্যপ্রাপ্তি আরো সহজ হয়েছে। অন্যদিকে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে হোক, বাংলাদেশে নীতিনির্ধারকরা দেশের অধিকতর কল্যাণের জন্য তথ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণে ব্যর্থ হয়েছে। অনেক সময় মনে হয়, বাংলাদেশে কর কর্তৃপক্ষ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি বিদেশী পাসপোর্ট, ‘নো ভিসা রিকোয়ার্ড’ স্ট্যাম্প ও একটি এনআইডি পেলেই নাগরিক সেবা দিতে উদগ্রীব! এর পেছনে অদৃশ্য সরকারি নীতিতে ডিসি সম্প্রদায়ের প্রভাবের কথা আগেই বলেছি। ভারতে অবশ্য কিছুটা পিছু হটে পরিবর্তন আনার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। ওসিআই (ওভারসিজ সিটিজেনস অব ইন্ডিয়া) ও পিআইওতে (পারসনস অব ইন্ডিয়ান অরিজিন), যে দুটো পরে একীভূত হয়েছে, তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে ভারত সরকার অধিকতর ভালো অবস্থানে আছে। অধিকন্তু কর কর্তৃপক্ষকে ‘রেসিডেন্সি’ নির্ধারণে এবং ওআইসি থেকে কর আদায়ে কঠোর হতে দেখা যায়। যদিও দক্ষিণ এশিয়ার তিন দেশের আইন ব্যক্তির নাগরিকত্ব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে ক্ষমতাচর্চার সুযোগ দেয়, তবে বিষয়টির স্বীকৃতি দেয়া এবং সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলো নিরসনের উদ্যোগ বাংলাদেশেই সবচেয়ে কম দৃশ্যমান।
দক্ষিণের তরুণদের ডিসিতে রূপান্তরে শিক্ষাবাজারের ভূমিকা
বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই, তবে ভবিষ্যতের ডিসিদের পরিপ্রেক্ষিতে না রাখলে বিশ্লেষণে অসম্পূর্ণতা রয়ে যাবে। অভিবাসনের উদ্দেশ্য নিয়ে অনেক তরুণই আজকাল বাইরে পড়তে যাচ্ছে, যাদের অধিকাংশই আগামীতে এফসিবিওতে রূপান্তর হওয়ার আশা রাখে। একবার এফসিবিও হওয়ার পর যে দেশ থেকে গেছে সে দেশের আপেক্ষিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার ওপর নির্ভর করে তাদের কেউ কেউ ডিসি হতে আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করতে পারে। নিজ নিজ সরকারের আর্থিক সমর্থন প্রত্যাহারের পর থেকে উত্তর গোলার্ধের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ক্রমেই বাণিজ্যিকীকরণ ঘটছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিসহ ভর্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে ডিসি সম্প্রদায়ের লোকরাই দক্ষিণের শিক্ষাবাজারে তত্পর থাকে এবং বলতে দ্বিধা নেই যে, এ শিক্ষা অভিবাসন প্রক্রিয়াকে (উত্তরের) সেসব দেশের কূটনীতিক মিশনগুলো সক্রিয়ভাবে সহায়তা প্রদান করে। এই সমগ্র প্রক্রিয়া আরো বেগবান হয় যখন দক্ষিণে প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয় ঘটে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং হতাশাগ্রস্ত তরুণদের মাঝে বহির্মুখিতা বৃদ্ধি পায়। একই দেশের শহর ও গ্রামের সম্পর্কে এসবই লক্ষণীয়, যা স্বাভাবিক। তবে দুটো দেশের ক্ষেত্রে দুটো ভিন্ন মুদ্রা ব্যবস্থা রয়েছে এবং দুটো জায়গার মাঝে অবাধ শ্রম চলাচল নেই। সে কারণে শিক্ষাসেবার বাজার ব্যবস্থাপনা যথার্থভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন (যা এখানে করিনি) এবং সরকার ও নির্দিষ্ট রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা চিহ্নিত করে সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া জরুরি।
[এ নিবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব]
[২য় পর্ব ]
ড. সাজ্জাদ জহির: অর্থনীতিবিদ, নির্বাহী পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ
Email: sajjadzohir@gmail.com
2536