সুদহার, মুদ্রা বিনিময় হার এবং মূল্যস্ফীতির বয়ানের পুনর্ভাবনা
February 16, 2025

দ্বৈত নাগরিকত্ব ও অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে বাংলাদেশকে

বণিক বার্তা |
সম্পাদকীয় |

৭ মার্চ, ২০২৫ |
ড. সাজ্জাদ জহির |

এটি জাতীয় পর্যায়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেখানে দ্বৈত নাগরিকত্ব, অর্থ পাচার ও বিদেশী নাগরিকত্ব গ্রহণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। প্রশ্ন জাগে, এসব ব্যক্তি প্রথমে অর্থ পাচার করে তারপর নাগরিকত্ব নিয়েছে?

(ড. সাজ্জাদ জহির, অলাভজনক বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের (ইআরজি) নির্বাহী পরিচালক। এর আগে তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়া তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন বিশ্বব্যাংক, আইএফসি, আইএফএডি, ইউনিসেফ, এফএও ও ডব্লিউএফপির মতো প্রতিষ্ঠানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করে পিএইচডি করেছেন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোতে। দ্বৈত নাগরিকত্ব ও অর্থ পাচারসহ নানা প্রশ্ন নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন বণিক বার্তায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবিদিন ইব্রাহিম)


– বাংলাদেশে অনেক শিল্পপতি ও ঋণখেলাপি বিদেশে নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। এমনকি সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও অনেকে এক বা একাধিক দেশের নাগরিক হয়েছেন। এটি রাজনীতি ও অর্থনীতির জন্য কী ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করছে? আমরা কীভাবে এটি প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি?

এটি জাতীয় পর্যায়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেখানে দ্বৈত নাগরিকত্ব, অর্থ পাচার ও বিদেশী নাগরিকত্ব গ্রহণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। প্রশ্ন জাগে, এসব ব্যক্তি প্রথমে অর্থ পাচার করে তারপর নাগরিকত্ব নিয়েছে? নাকি পূর্ব থেকে নাগরিকত্ব থাকায় অর্থ পাচার করতে সুবিধা হয়েছে?

সাধারণভাবে দেখা যায়, বিদেশী নাগরিকত্ব থাকলে অনেক ক্ষেত্রে অর্থ বিদেশে পাচার করা সহজ। কারণ পাচার করা অর্থ অবৈধভাবে গেলেও গন্তব্য দেশে আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত থাকায় সেই দেশে অতীতে বৈধতা পেতে দেখা গেছে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকিং ব্যবস্থা এড়িয়ে বিদেশের বসতিরা নগদ অর্থ দৈনন্দিন খরচে ব্যবহার করতে পারেন। শুধু অর্থ পাচার নয়, দ্বৈত নাগরিকদের হাতে অন্য দেশের পাসপোর্ট থাকায় রাজনৈতিক বা সামাজিক অপকর্মের পর তাদের অনেকেই সহজে দেশ ছাড়তে পেরেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি, কীভাবে কয়েকজন ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তি দ্রুত দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। যেমন ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে কিছু ব্যবসায়ী কানাডা, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ার নাগরিকত্ব নিয়েছেন অথবা দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকার ফলে বিচার এড়ানোর উদ্দেশ্যে বাংলাদেশী নাগরিকত্ব ত্যাজ্য করেছে। বণিক বার্তার বরাতে জানা যায় যে প্রবাসী কল্যাণ বোর্ডের তথ্যমতে, অনেক প্রবাসী বাংলাদেশীরা কেবল বৈধ প্রক্রিয়ায় টাকা উপার্জন করলেও কিছু অসাধু ব্যক্তি এ প্রবাসী পরিচয়ের আড়ালে রাষ্ট্রীয় সম্পদ পাচার করছে।

দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে বহুদিন ধরেই আলোচনা চলছে। বণিক বার্তাসহ অন্যান্য পত্রিকায় প্রায় দুই বছর ধরে আমি এ নিয়ে লিখেছি। নির্বাচনকালে বিষয়টি বেশ আলোচনায় এসেছিল এবং কিছু প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বীরা মামলা করেছিলেন, যা পরে আদালতের বেড়াজালে ধামাচাপা পড়ে যায়। তবে ইদানীংকালে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক মাধ্যমে দুটো প্রবণতা লক্ষ করা যায়। কিছু সরকারি উপদেষ্টা ও নীতিনির্ধারক ‘প্রবাসী’ শব্দটিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে পুনরায় দ্বৈত নাগরিকদের বিশেষ সুবিধা দিতে সচেষ্ট। ‘ডায়াসপোরা’ বা প্রবাসী বলতে সেসব বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্যক্তিকে বোঝানো হয়, যারা ভিনদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে দীর্ঘমেয়াদে বিদেশে বসবাস করছে। এর বিপরীতে অস্থায়ীভাবে বিদেশে অবস্থানরত বা বসবাসকারী বাংলাদেশী নাগরিকদের ‘‌অনিবাসী বাংলাদেশী’ (এনআরবি অর্থাৎ নন-রেসিডেন্ট বাংলাদেশী) বলা হয়। বিদেশে নাগরিকত্ব গ্রহণ করা ব্যক্তিরা একসময় সরাসরি নিজেদের এনআরবি বলে পরিচয় দিত। এখন প্রবাসী লেবাসের অন্তরালে তারা একই পরিচয় দখলে নিয়ে রেমিট্যান্স যোদ্ধা এনআরবিদের কৃতিত্ব নিতে চাইছে এবং বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে, কর্মস্থলে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ সুবিধা পেতে সচেষ্ট। সেই প্রক্রিয়ায় ‘ডায়াসপোরা’ বা প্রবাসী সম্প্রদায়ের কেউ কেউ ক্ষণেকের জন্য হলেও তৃতীয় একটি শ্রেণীতে রূপান্তরিত হয়েছে। এরা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বিদেশী নাগরিক (অর্থাৎ ফরেন সিটিজেনস অব বাংলাদেশ অরিজিন, এফসিবিও), যারা দ্বৈত নাগরিকত্বের আড়ালে বাংলাদেশে বিভিন্ন মাত্রায় সময় কাটান। এদের একাংশ শেকড়ের টানে বেড়াতে আসেন অথবা জন্মভূমির কল্যাণে নিজের অর্থ ও সময় দেন। কিন্তু উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রয়েছে যারা দেশের সরকারি-বেসরকারি খাতে কর্মরত এবং তাদের সঞ্চয় মূলত বিদেশে ব্যয় হয় বা সম্পদে রূপ নেয়। এর সবই চলে দ্বৈত নাগরিকত্বের ছত্রচ্ছায়ায়। চলমান এ প্রথম প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে না আনলে রাষ্ট্রগঠনের প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে এবং ভিন্ন দেশে বশ্যতাগ্রহণকারী দ্বৈত নাগরিকদের ওপর প্রাতিষ্ঠানিক নির্ভরশীলতা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে অধিক অনিশ্চয়তায় ফেলবে।

এসবের মাঝে যৎসামান্য আশার আলো দেখায় দ্বিতীয় একটি প্রবণতা, যা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কিছু সুনির্দিষ্ট উদ্যোগে লক্ষ করা গেছে। সম্প্রতি (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০২৫) দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণ করা ‘পাবলিক সার্ভেন্টস’দের তাদের পাসপোর্ট ও সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। লক্ষণীয় যে এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, (ক) প্রতিরক্ষা বিভাগে কর্মরত সব কমিশন্ড অফিসার, (খ) আদালতে কর্মরত কর্মচারী ও বিচারক, (গ) সরকারি রাজস্ব খাত হতে বেতনভুক্ত সব কর্মচারী, (ঘ) সব স্বায়ত্তশাসিত, স্বশাসিত, আধা সরকারি বা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিতে কর্মরত সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং (ঙ) বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। জানা যায় যে এ তথ্য প্রদানে ‘পাবলিক সার্ভেন্টস’দের কাছ থেকে সাড়া পেতে বিলম্ব হচ্ছে। তবে এ তথ্য কী উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করা হচ্ছে তা আজও স্পষ্ট নয়। যেভাবে প্রবাসী শব্দের ধূম্রজালে এফসিবিও ও এনআরবিদের মধ্যকার তফাৎ আড়াল করা হচ্ছে, একইভাবে নাগরিকত্ব পরিচয় জানতে চেয়ে যেন সংবিধানসম্মত নাগরিক আইন প্রয়োগের দায় থেকে কর্তৃপক্ষ অব্যাহতি না নেয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, তদানীন্তন পাকিস্তানের ১৯৫১ সালে ও পরবর্তী ১৯৭২ সালের সংবিধানে নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে মূলনীতি ছিল—যদি কেউ অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে, তবে তাকে অবশ্যই নিজ দেশের (বাংলাদেশের) নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে হবে।

আজ সবাই জানেন যে অনেক ব্যক্তি বিদেশী নাগরিকত্ব নিয়েও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে, এমনকি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছেন। দ্বৈত নাগরিকদের অনেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে এবং অর্থ পাচারের সঙ্গে তারা ঋণখেলাপি ও দেশান্তর হলে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।

– তাহলে সমাধান কী? আমরা কীভাবে এ বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি?

প্রথমত, প্রতিটি নাগরিকের নাগরিকত্বের তথ্য সরকারিভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। কেউ যদি বিদেশী নাগরিকত্ব গ্রহণ করে, তবে সেটি সরকারি নথিতে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। এনআইডি প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য অনন্য পরিচয় (সংখ্যা) দিয়েছে, যার সঙ্গে জন্মনিবন্ধনের পরিচিতির যোগসূত্রটা টানা জরুরি। এ তথ্যভাণ্ডার একচ্ছত্র আধিপত্যে দিলে ডিজিটাল যুগের স্বৈরতন্ত্র উদ্ভবের সম্ভাবনা থাকে। তাই তথ্যের গোপনীয়তা নিশ্চিত করে সম্মুখভাগের ব্যবহারকারীদের জন্য সংরক্ষিত তথ্যের রক্ষক এবং পেছনের তথ্যভাণ্ডারের রক্ষক পৃথক হওয়া কাম্য। দ্বিতীয়ত, নাগরিকত্বের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা জরুরি এবং বিদেশী নাগরিকত্ব নেয়া (এককালীন নাগরিক) ব্যক্তিদের পৃথক গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করা আবশ্যিক। নাগরিকদের মাঝে কে অনিবাসী বাংলাদেশী তা এনবিআর আইনে নিবাসকাল ভিত্তিতে নির্ধারিত। বিদেশী নাগরিকত্ব নেয়া প্রবাসীদের সঙ্গে এক করে দেখানো প্রবঞ্চনা হিসেবে গণ্য করা প্রয়োজন। ইন্ডিয়ার মতো অনেক দেশে নাগরিকত্ব স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত রয়েছে। সেখানে কেউ বিদেশী নাগরিকত্ব নিলে ইন্ডিয়ার নাগরিকত্ব হারাতে হয়, যদিও তাদের সংবিধানে প্রবাসীদের জন্য কিছু নির্দিষ্ট সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। সংবিধানে নাগরিকত্ববিষয়ক (দ্বিতীয়) অধ্যায় গায়েব হওয়ার বিষয়টি অনুসন্ধান করলে অনেক কিছুই জানা সম্ভব। এছাড়া ব্যাংক ঋণের বিষয়ে কঠোরতা প্রয়োজন। বর্তমানে দেখা গেছে, বিদেশী নাগরিকত্বধারী অনেক ব্যক্তি বাংলাদেশে ঋণ নিয়ে তা বিদেশে পাচার করেছে, যা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। একটি উদাহরণ দেয়া যায়, বাংলাদেশের কিছু বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক যারা সরকারি ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন, পরবর্তী সময়ে তারা বিদেশে নাগরিকত্ব গ্রহণ করে সেই টাকা সরিয়ে ফেলেছেন। ফলে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের চাপে পড়ে গেছে, যা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য হুমকি।

– বিশ্বে দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয়ে কড়াকড়ি বাড়ছে। বাংলাদেশ কি ভবিষ্যতে আরো কঠোর নীতিমালা গ্রহণ করতে পারে?

নিঃসন্দেহে, বিশ্ব আগের মতো উদার নেই। অনেক দেশ এখন দ্বৈত নাগরিকত্ব ও অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর হচ্ছে। বাংলাদেশকেও এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মতো দেশে কেউ যদি অন্য দেশের নাগরিকত্ব নেয়, তাহলে তাকে নির্দিষ্ট কর দিতে হয় এবং তার সম্পদের উৎস স্বচ্ছ হতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো এ বিষয়ে কঠোর নিয়ম চালু হয়নি।

বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নাগরিকত্ব ও জাতীয় স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করা। যারা বিদেশী নাগরিকত্ব নিচ্ছেন তাদের জন্য শুভকামনা থাকবে, কিন্তু তাদের প্রতি বাংলাদেশের দায়িত্ব সীমিত। কারণ তারা এখন অন্য দেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করছেন।

আজকের বিশ্বে জাতীয় স্বার্থরক্ষার জন্য নিবন্ধন ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, নাগরিকত্বের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। প্রশ্ন হলো, সরকার সেই পথ খুঁজে নিতে কতটা আন্তরিক হবে?

Source:https://bonikbarta.com/editorial/SIqLYO9UtTQ5desN

116