কালবেলা |
মতামত | উপ-সম্পাদকীয় |
৩০ আগস্ট ২০২৩ |
ড. সাজ্জাদ জহির |
বাংলাদেশের চলমান অনৈক্যের সাথে জড়িয়ে আছে দেশ ও জনগণের জন্য গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়ে মতবিনিময়ের অনুপস্থিতি এবং মত-পার্থক্য মেটানোর স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার অভাব। সর্বোপরি, আঞ্চলিক ও বিশ্বপরিসরের পরাশক্তিদের কাছে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিত্বের নতজানু অবস্থান আমাদের তরুণদের মাঝে তীব্র হীনমন্যতা বোধের জন্ম দিচ্ছে। একইসাথে বিভিন্ন পেশায় শিক্ষিত সমাজের শীর্ষস্থানীয়দের এক বিশাল অংশ, ধোঁয়াশা দ্বৈত নাগরিকত্বের আশ্রয়ে ভিনদেশের প্রতি আনুগত্যে আবদ্ধ। অথচ, তাদের কেউ কেউ আজ রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের ও নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে রাষ্ট্র-নির্মাণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। আগামীতে কারা কোন প্রক্রিয়ায় এই ভূখণ্ডকে শাসন করার ন্যায্য অধিকার পাবেন, সে আলোচনা এখানে করব না। একটি সমৃদ্ধশীল, সৌহার্দ্যপূর্ণ ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়া এবং এখানকার সব নাগরিক যেন সম্মানের সাথে বিশ্বপরিসরে বিচরণ করতে পারে, সেসব অর্জনের জন্য রাষ্ট্রকে পুনর্গঠন করা প্রয়োজন। তাই, ক্ষমতায় যেই আসুক না কেন, সেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিবেচনার জন্য কয়েকটি প্রস্তাবনা রাখব, যার মাত্র দুটি পৃথক দুই পর্বে উল্লেখ করব।
১। রাষ্ট্রের পরিসীমা– ভৌগোলিক ও জনগোষ্ঠীভিত্তিক
একটি দেশের ভৌগোলিক পরিসীমা থাকে এবং বাংলাদেশের মানচিত্র, যার সীমানা প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে চুক্তির মাধ্যমে স্বীকৃত, তা আজকের ডিজিটাল যুগে অতি সহজেই স্থায়ীভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব। তবে রাষ্ট্রের পরিসীমা কি কেবলই দেশের ভৌগোলিক পরিসীমার মাঝে আবদ্ধ থাকবে? আরও দুটো ক্ষেত্র রয়েছে— ‘জল ও ভূগর্ভস্থ সম্পদ’ এবং জনগোষ্ঠী, যা ভৌগোলিক সীমানাকে পেরিয়ে যায়। প্রথমটির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কনভেনশন রয়েছে, তাই আলোচনায় তুলছি না। জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে রাষ্ট্রের দায়িত্ব-বলয় সুনির্দিষ্ট করার উদ্দেশ্যে নিম্নে কিছু প্রসঙ্গ তোলা হয়েছে।
রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব তার নাগরিকের প্রতি, বিশেষত, দেশের ভৌগোলিক সীমানার অভ্যন্তরে অবস্থিত নাগরিকদের প্রতি। তবে, এর কিছু ব্যতিক্রম থাকতে পারে, যা কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিয়ে নিম্নে উল্লেখ করছি। বাংলাদেশের অনেক নাগরিক বিদেশে কর্মরত রয়েছেন। তাদের দেখভাল করার দায়িত্ব যেমন সেখানকার নিয়োগকারী ও সেদেশের সরকার-নিযুক্ত কর্তৃপক্ষের, তেমনি, সেইসব শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও বিদেশের মাটিতে সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত করার দায়িত্ব বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ওপরও বর্তায়। একইভাবে বাইরে পড়তে যাওয়া ছাত্রছাত্রী, ব্যবসায়ী অথবা ভ্রমণকারীদের প্রতি সেজাতীয় দায়িত্ব রাষ্ট্রের রয়েছে। উপরের দায়িত্বের ব্যতিক্রম ঘটে সেসব ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে যারা ভিনদেশের নাগরিকত্ব নিয়েছে। এক্ষেত্রে নাগরিকত্ব খারিজের বিষয়ে সাংবিধানিক অস্পষ্টতার আড়ালে এবং কথিত দ্বৈত নাগরিকত্বের বিশৃঙ্খলায় এককালীন উপনিবেশিক দেশগুলো আমাদের মতো দেশগুলোর মেধা, সম্পদ ও কর্মসংস্থান আত্মসাৎ করতে সক্ষম। এবিষয়ে সংবিধানে সংশোধনী জরুরি, যা দ্বিতীয় প্রস্তাবনায় উত্থাপন করা হয়েছে।
প্রকৃত নাগরিকদের বাইরে জনগোষ্ঠীর পরিচয়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের দায়িত্বের পরিধি বিস্তৃতভাবে দেখা সম্ভব। নৃ-জাতি, ভাষা ও ধর্মকে ঘিরে আমাদের আত্মপরিচয় বিকশিত হয়েছে, যা নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মাঝ দিয়ে রাজনৈতিক পরিসরে একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। পরিচয়ের প্রথম দুটো দিক (নৃ-জাতি ও ভাষা) সমধর্মী, যদিও শংকর হওয়ার কারণে বাঙালিকে ভাষার ওপর বেশি ভর করতে হয়। তবে, ঐতিহাসিকভাবে উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চল, ইরান, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, ইত্যাদি এলাকা থেকে আসা মানুষের সাথে সংমিশ্রণ ঘটলেও আজ সে অতীত আমাদের বর্ণ ও ধর্মে ছড়িয়ে আছে। একই মন্তব্য সম্ভবত বৈদিক যুগের বাইরে থেকে আসা সংস্কৃত ভাষাভাষীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ভৌগোলিকভাবে, পাশাপাশি জড়িয়ে সহাবস্থান করছে অসংখ্য ক্ষুদ্র নৃ-জাতি, যাদের থেকে প্রাচীন বাংলা ও বাঙালির ব্যুৎপত্তি ঘটেছিল। উভয় অর্থনীতি ও রাজনীতির প্রেক্ষিতে এই বর্তমানটাই অধিক প্রাসঙ্গিক। সেটাকে বিবেচনায় নিলে, তিনটি জনগোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব ভেবে দেখা প্রয়োজন, যাদের প্রতিটিই সীমান্তের ভেতরে ও বাইরে অবস্থান করে (ইংরেজিতে যাদের ট্রান্স-বর্ডার কমিউনিটি বলা হয়)। প্রথমটি হলো, ধর্মসূত্রে এখানকার জনগোষ্ঠীর সাথে যারা সম্পর্কিত, অথচ যাদের অনেকের সাথে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক নেই। দ্বিতীয়টিতে রয়েছে পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী, বিশেষত, সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় যারা বসবাস করেন। তৃতীয় জনগোষ্ঠীতে রয়েছে বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, যাদের এক বা একাধিক ধারা বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার অভ্যন্তরে বাস করে এবং এদেশেরই নাগরিক। তবে সেসব নৃগোষ্ঠীর অন্য অনেকে সীমান্তের ওপারে বসবাস করে। যদিও এই শেষোক্ত জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলা নয়, এটা আজ অনেকের মাঝে স্বীকৃত যে তাদের অনেকের ভাষা মিশ্রিত হয়ে প্রাচীন বাংলার জন্ম দিয়েছিল। এদের মাঝে সাঁওতাল, অহমীয়া (অসমীয়া), মণিপুরি, গারো, হাজং, চাকমা, খাসিয়া, ত্রিপুরী বা করবরক, মারমা, কুকি-চিন-মিজো গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত লুসাই, বম, পাংখো ও খুমি এবং আরাকানি (রোহিঙ্গা) উল্লেখযোগ্য।
শ্রেণি-প্রতিনিধিত্বকারী রাষ্ট্রব্যবস্থার আলোচনায় না গেলেও কেউ কেউ, ক্ষুদ্র আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে, রাষ্ট্রের ভরণপোষণকারীদের মাঝেই রাষ্ট্রের দায় সীমাবদ্ধ রাখার প্রস্তাব দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে অনেকে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বিনিয়োগের খাত হিসেবে গণ্য করতে পারে। সেই যুক্তির আড়ালে দেশি-বিদেশি যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান একটি রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের সম্পদ লুণ্ঠন করতে পারে, যেমনটি করেছিল উপনিবেশিক (পশ্চিমা) দেশগুলো। বর্তমানকালে, এর একটি চরম প্রকাশ দেখতে পাই যখন আর্থিক ব্যবস্থা থেকে অর্থলুট, সংগ্রহ চুক্তির আড়ালে অথবা কর্মস্থল দখল করে সম্পদ পাচার এবং ঋণের দায়ভার স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার উজাড় হতে থাকা। আধুনিক অর্থব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ নীতিতে দেনার এই দায়ভার মেটাতে একপর্যায়ে বাংলাদেশের সম্পদের মালিকানা বিদেশিদের হাতে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তাই পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কাদের ও কিসের জন্য এবং তার দায়বদ্ধতা কাদের প্রতি থাকা বাঞ্ছনীয়, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। উল্লিখিত বিষয়গুলো সার্বিকভাবে মীমাংসা না করলে একটি বহুজাতিক এবং বহু ধর্মাবলম্বীদের রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আমার মূল প্রস্তাব, রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব বাংলাদেশের নাগরিকের প্রতি, যারা অন্য কোনো দেশের প্রতি আইনি অনুগত্যে জড়াবেন না এবং বাংলাদেশের প্রতি অনুগত থাকবেন। তবে, আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ গুণতিতে রেখে, পূর্বে উল্লিখিত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাথে সুসম্পর্ক রাখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে আমি মনে করি। আন্তর্জাতিক কূটনীতির অঙ্গনে পথটি নিঃসন্দেহে পিচ্ছিল, তবে নীতিপর্যায়ে স্পষ্টতা সার্বভৌমত্বের জন্য আবশ্যিক।
এই অংশ শেষ করব, প্রতিবেশী দেশগুলোর জনগোষ্ঠীভিত্তিক কিছু অভিবাসন নীতির দৃষ্টান্ত দেখিয়ে। প্রথমেই উল্লেক্ষ- ইন্ডিয়ার নীতি অথবা ইন্ডিয়া নামক দেশটি যে স্বার্থের দ্বারা চালিত তাদের জনগোষ্ঠীকেন্দ্রিক নীতি। এপার থেকে দেখা মাত্র দুটো দিক উল্লেখ করব। সেদেশের সরকার ধর্মকে উল্লেখ করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বী জনসাধারণদের জন্য সেদেশে দীর্ঘকাল বসবাসের জন্য বিশেষ ভিসার সুযোগ দেয়। কিন্তু মজার ব্যাপার, ইন্ডিয়ার কেন্দ্রীয় সরকার নিজ দেশের অভ্যন্তরে অনেক রাজ্যের ক্ষেত্রে নৃজাতির (বা ভাষার) ভিত্তিতে এনআরসি ও অন্যান্য নীতি অনুসরণ করে। প্রথম (ধর্মভিত্তিক) নীতি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিবেশীদের ওপর নিঃসন্দেহে বাড়তি বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে এবং এজাতীয় নীতি ক্ষুদ্র পরিসরে জাতি ও রাষ্ট্র গঠনকে দুরূহ করে। দ্বিতীয়টির তাৎপর্য সমরূপ, তবে তা উন্নয়নের নামে কোন কোন অঞ্চল বা রাজ্যকে দ্বিখণ্ডিত করে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থে অনবায়নযোগ্য সম্পদ লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে নেওয়া হয় বলে অনেকের ধারণা।
মিয়ানমারের সরকার সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর সমর্থনে দীর্ঘকাল বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে নিপীড়ন করে আসছে, যা বহুক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি আর্থিক স্বার্থের সাথে জড়িত। শেষোক্তটির একটি প্রকাশ হচ্ছে আরাকান থেকে সেখানকার জনবসতি উচ্ছেদ। উল্লেখ্য, রাখাইন/আরাকান রাজ্যে সিতওয়ের উপকূলে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং চীনের কুনমিং অবধি জ্বালানি তেল ও গ্যাসের পাইপলাইনের নিরাপতা বিধান জরুরি ছিল। মিয়ানমারের নাগরিক নিবন্ধন কার্যক্রমে, আমার জানামতে, ইন্ডিয়ানরা একটি নাগরিক গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত এবং বাঙালি নামে একটি ভিন্ন শ্রেণি রয়েছে, যেখানে হিন্দু-মুসলমানভিত্তিক বিভাজনের কোনো অস্তিত্ব নেই!
উপরের দৃষ্টান্তগুলো দেওয়ার মূল কারণ, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর বৈরী নীতির প্রেক্ষিতে রাষ্ট্র-গঠনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের কি ধরনের নীতি অনুসরণ করা উচিত, তা সুচিন্তিতভাবে প্রণয়ন করা প্রয়োজন। একাজের জন্য নাগরিকত্বের সীমানা টানা জরুরি, যা পরবর্তী পর্বে আলোচনা করা হবে।
(নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব)
ড. সাজ্জাদ জহির: অর্থনীতিবিদ; নির্বাহী পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ (ইআরজি)
sajjadzohir@gmail.com
Source: https://www.kalbela.com/opinion/sub-editorial/19292
1315