Who is in charge? Who do we convey our suggestions to?
May 21, 2020
Belittling our intelligence!
June 13, 2020

অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনার ওপর কভিড-১৯-এর প্রভাব

দৈনিক বণিক বার্তা ।
জুন ০৪, ২০২০ ।

ড. সাজ্জাদ জহির ।

 

কয়েকটি বিষয় ঘিরে পত্রপত্রিকায় কভিড-১৯-এর আলোচনা হয়। সংগত কারণে সংক্রমণ রোধের প্রায়োগিক দিক সেই আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে। সেই সঙ্গে আমাদের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের ওপর প্রভাব, সম্ভাব্য প্রণোদনামূলক নীতিমালা ও আপত্কালীন সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য করণীয় বিষয়গুলো অধিক গুরুত্ব পেয়েছে। নীতি বাস্তবায়নে ব্যর্থতা তুলে ধরতে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুর্নীতি ও সুশাসনের বিবিধ দিকও আলোচনায় এসেছে। সেসবের বাইরে থেকে এ নিবন্ধে সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির মিশ্রিত অঙ্গনে চলমান পরিবর্তনের ওপর আলোকপাত করে নিকট ভবিষ্যেক বুঝতে চেষ্টা করব। প্রাসঙ্গিক বিধায় অর্থনীতির কিছু মৌলিক ধারণার আশ্রয় নিতে হয়েছে। আশা করব পাঠকদের ধৈর্য থাকবে।

২০১১ সালে ইউএনডিপি ও ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশন অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন-পরিকল্পনার তত্ত্বগত ভিত্তি নিরূপণের উদ্দেশ্যে দিল্লিতে একটি সম্মেলন করেছিল। সে অনুষ্ঠানের একটি সেশনে মূল উপস্থাপক হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সম্পদ মালিকানায় আমূল পরিবর্তন না এনে সমাজে বৈষম্য দূর করার তিনটি পথের উল্লেখ আমার উপস্থাপনায় করেছিলাম, যার সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ:

— প্রথমত, রাষ্ট্রের মাধ্যমে ধনীদের থেকে সংগৃহীত কর-রাজস্ব পুনর্বণ্টন এবং অর্থ সরবরাহের ওপর নিয়ন্ত্রণ থেকে সরকার অর্জিত অর্থসম্পদ বিত্তহীনের মাঝে বণ্টন করে অনেকাংশে বৈষম্য দূর করা সম্ভব। এ পথের ভিন্ন একটি সংস্করণে, সরকার দেশের অভ্যন্তর থেকে অথবা বিদেশ থেকে দেনা করে (ধনীকে অধিক ধনী না করে) দরিদ্র জনসাধারণকে অধিক সহায়তা দিতে পারে। উল্লেখ্য, দুটো পথের তাত্পর্য ভিন্ন, যদিও বাংলাদেশে উভয় ব্যাংকসৃষ্ট অর্থ ও বৈদেশিক দেনা বিত্তবানদের সম্পদ বৃদ্ধিতে এবং অর্থ পাচারে সহায়তা করেছে। রেমিট্যান্সপ্রবাহ বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ নিশ্চিত করে সেই পাচারকে সম্ভব করেছিল।

— দ্বিতীয়ত, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় দরিদ্র জনসাধারণের শ্রমসংস্থানের মাধ্যমে জাতীয় আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও আয় বৃদ্ধি নিশ্চিত করে বৈষম্য রোধ বা হ্রাস করা। উভয় মজুরি শ্রম ও স্বনিয়োজিত শ্রম ব্যবহারের মাধ্যমে কর্মসংস্থান হতে পারে। এ পথেরও একটি ভিন্ন সংস্করণ রয়েছে, যেখানে তুলনামূলকভাবে দরিদ্র পরিবারের সদস্যদের বিদেশে অস্থায়ী কর্মসংস্থানের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি ও দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন সম্ভব করা হয়।

— আয়বৈষম্য হ্রাসের তৃতীয় পথটি অভিনব এবং পরিমার্জিত জ্ঞানের মোড়কে বিজ্ঞজনদের উপস্থাপনায় দ্বিতীয় পথের সঙ্গে তার ভিন্নতা অদৃশ্য রয়ে যায়! প্রাথমিক উৎপাদন ও সম্পদ মালিকানা থেকে অর্জিত আয় (সঞ্চয় বাদ দিলে) অর্জনকারীর বিবিধ ভোগ মেটাতে ব্যয় করা হয়। এসব ভোগদ্রব্যের অনেকগুলোই প্রাথমিক উৎপাদনকার্যের ফসল। কিন্তু মোট ভোগের একটি উল্লেখজনক অংশ সেবাধর্মী, যা দৈনন্দিন জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আনতে সহায়ক এবং কার্যত দরিদ্র জনসাধারণের শ্রমের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় সে-জাতীয় ভোগ তাদের আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। শেষোক্ত বিষয়টি নিয়ে আজকের মুখ্য আলোচনা, যা সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

বাহ্যিকভাবে আয়বৈষম্য কমা অথবা দরিদ্র জনসাধারণের আয় বৃদ্ধি বা দারিদ্র্য হার কমা উপরোক্ত তিনটি পথের (বা তন্মধ্যের উপপথের) দ্বারা অর্জন সম্ভব। কিন্তু দ্বিতীয়টিকেই সম্মানজনক পথ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং সেই পথের ওপর ভিত্তি করে দিল্লি সম্মেলনে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রস্তাবনা রেখেছিলাম। সরকার মুখাপেক্ষিতা (প্রথমটির ক্ষেত্রে) এবং ‘মনিব’ বা ‘নিয়োগ কর্তা’ মুখাপেক্ষিতা (তৃতীয়টির ক্ষেত্রে) আমাদের সমাজকে সেই সম্মানের জায়গায় পৌঁছানোর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আরো উল্লেখ্য যে উপরোক্ত বিশ্লেষণ-কাঠামোয় সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমসহ বিবিধ শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব। এ নিবন্ধে অবশ্য শুধু করোনাকালে ‘মনিব’ মুখাপেক্ষিতার তাত্পর্য আলোচনা করা হয়েছে। এর বাইরে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নেতা মুখাপেক্ষিতা যেমন আন্তর্জাতিক শক্তিবলয়ের অধীনস্থ হওয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, একইভাবে সরকার মুখাপেক্ষিতার সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধির যোগসূত্র রয়েছে। এ দুটো বিষয়ই এ নিবন্ধের আলোচনার বাইরে রাখা হয়েছে।

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের সমাজ গবেষণায় স্বপন আদনানের নামটি সুপরিচিত। তিনি সত্তরের দশকের শুরুতে দাবি করেছিলেন যে সে সময়কার গ্রামীণ সমাজে মার্ক্সীয় ধারায় শ্রেণীবিভাজন না ঘটে লম্বালম্বি সংযুক্তির (ভার্টিক্যাল ইন্টেগ্রেশনের) প্রাধান্য ছিল। অর্থাৎ একজন ধনী বা মোড়ল শ্রেণীর ব্যক্তি বা পরিবারের সঙ্গে অনেক গরিব পরিবার সামাজিকভাবে সংযুক্ত ছিল, যে কারণে সামাজিক বিরোধ মূলত এক বাড়ির সঙ্গে অন্য বাড়ির অথবা এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে অন্য সম্প্রদায়ের বিরোধরূপে সংগঠিত হতো। সম্ভবত সে কারণেই ষাট ও সত্তরের দশকের অতি বামদের ‘শ্রেণীশত্রুবিরোধী’ আন্দোলন কখনই সাধারণ মানুষের সহানুভূতি পাইনি।

আশি ও নব্বইয়ের দশকে ব্যাপক অর্থনীতিক বিবর্তন এসেছে এবং ক্ষুদ্রঋণের প্রসার ও শ্রম রফতানির কারণে আমাদের গ্রাম-সমাজের প্রচলিত বাঁধন অনেকটাই ভঙ্গুর হয়ে আসে। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যে এবং শহুরে জীবনযাত্রায় ‘মনিব’ বা ‘নেতা’ মুখাপেক্ষিতা রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেঁথে বসে, যা অদৃশ্য (করোনা) ভাইরাসের আক্রমণে আজ কিছুটা নড়বড়ে ও অনিশ্চয়তার সম্মুখীন। এই দুর্যোগকালে পরজীবীপুষ্ট সমাজ পাল্টে আমরা সভ্য ও সুশীল হব, নাকি নিম্নস্তরের সামাজিক ভারসাম্যে নিমজ্জিত হব, সেটা আমাদের নেতৃত্বের জ্ঞানভিত্তিক (ও তথ্য) কৌশল নির্বাচনের ওপর নির্ভর করে। সে ব্যাপারে আশান্বিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ না পেয়ে একটি অনুল্লিখিত বিষয়ের ওপর সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

ব্যাখ্যা না দিয়েই প্রস্তাবনাকারে মত দিচ্ছি। আমাদের সমাজে ন্যূনতম তিন শ্রেণীর পরজীবী আছে—(১) আন্তর্জাতিক পুঁজির সহায়ক হিসেবে তাদের ঋণপুষ্ট প্রকল্প অথবা প্রকিউরমেন্টের (আহরণ কর্মের) সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত সমাজের শিক্ষিত ও অবস্থাপন্নদের একাংশ, (২) দেশের অভ্যন্তর থেকে আইনবহির্ভূত পথে অথবা ক্ষমতার অপব্যবহার করে যারা ব্যক্তি আয়, অর্জন বা তা বৃদ্ধি করে এবং (৩) উল্লিখিত দুই শ্রেণীর লোকসহ বিপুলসংখ্যক উপার্জনকারী, সঞ্চয় ভাঙিয়ে চলা অবসর যাপনকারী ও রেমিটেন্সনির্ভর পরিবারের সদস্যদের স্বাচ্ছন্দ্য ও শৌখিনতা নিশ্চিত করতে যারা বিভিন্ন ধরনের সেবা দেন। লক্ষণীয়, পরজীবী কথাটি ব্যবহার করলেও তা পূর্ণাঙ্গ অর্থ বহন করে না। কারণ এরা নির্দিষ্ট পরস্পর নির্ভরশীল সম্পর্কের একটি দিক মাত্র।

এ নিবন্ধে কেবল তৃতীয় শ্রেণীর ‘পরজীবী’দের উল্লেখ করা হয়েছে। বাসা ও অফিসে মেশানো শহুরে জীবনে বিত্তবানদের শৌখিনতা নিশ্চিত করতে বিশেষ কয়েকটি সেবা সচরাচর দেখা যায়। বাসায় রান্না ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষার জন্য গৃহকর্মী, চলাচলে সহায়তা করার জন্য গাড়ির চালক, দালানের দেখভাল করার জন্য নিরাপত্তাকর্মী ও কেয়ারটেকার। অফিসের কাজে রয়েছে বয়-বেয়ারা, অতিরিক্ত মেসেঞ্জার ইত্যাদি। এই সেবাকর্মীর তালিকায় কেউ কেউ রিকশাচালককে অন্তর্ভুক্ত করবেন, কারণ তারাও অবস্থাপন্নদের জীবনে (অনেক ক্ষেত্রে অনাবশ্যিক) অথবা যেসব কর্মী বিত্তবানদের সেবা দেন, তাদের যাতায়াতে স্বাচ্ছন্দ্য আনতে সহায়তা করেন।

নিবন্ধটি লিখতে বসে উপলব্ধি করছি যে এসব ‘মনিব’নির্ভর সেবাকর্মীকে যে বেতন-ভাতা বা পারিশ্রমিক দেয়া হয়, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে (বিবিএস জরিপে) ভোক্তার (খানা) খরচে ধরা পড়ে না। যে সমাজ ও অর্থনীতিতে কর ফাঁকি দেয়া অর্থের আধিক্য থাকে এবং নগদে সেবা ক্রয় সহজ, সেখানে এ-জাতীয় ব্যয় কাগজে-কলমে অদৃশ্য রয়ে যায়। রাজনীতির অঙ্গনেও অনুসারীদের ভরণ-পোষণের হিসাব দৃষ্টির অগোচরেই রয়ে যায়। তাই জাতীয় জরিপ থেকে আমার প্রস্তাবনার পক্ষে বা বিপক্ষে তথ্য দেয়া দুষ্কর। তথাপি চলতে ফিরতে শহুরে জীবনের প্রতিটি পদে উল্লিখিত সেবাকর্মীদের চাক্ষুষ দেখলে তথাকথিত এভিডেন্সের প্রয়োজন হয় না।

অধিকাংশ উন্নত দেশে কেবল উচ্চবিত্তদের পক্ষে এ-জাতীয় সেবা পাওয়ার সুযোগ ছিল। সে তুলনায় দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে সমাজ ও সংস্কৃতি ‘বাঙালি বাবু’র সমতুল্য মধ্যবিত্তের দ্বারা প্রভাবান্বিত হওয়ায় সমাজ ও অর্থনীতিক সংগঠনে মনিবনির্ভর সেবাকর্মী ও সেবানির্ভর বাবুদের পরস্পর নির্ভরশীলতা প্রকটভাবে নজরে পড়ে। এই বাঁধুনি যেমন সমাজকে এক ধরনের স্থিতিশীলতা দেয় ও একজনের আয় অনেকের মাঝে ছড়িয়ে দেয়, তেমনি এর মাধ্যমে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত সামাজিক সম্পর্ক স্থায়িত্ব পায়। সেবাকর্মীর সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে সে সম্পর্কে বেঁচে থাকার জন্য অন্যের গোলামি করতে হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মনিবের স্বার্থ রক্ষার্থে জীবন পণ করতে হয়। বেঁচে থাকার মৌলিক উপাদান মেটাতে সরকারনির্ভরতা বা রাজনীতিতে নেতানির্ভরতা সামাজিক সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সেই তুলনায় সমাজ-অর্থনীতিতে, বিশেষত তথাকথিত করপোরেট জগতে এই লম্বালম্বি সংযুক্তিভিত্তিক (ভার্টিক্যাল ইন্টিগ্রেশন) নির্ভরশীলতা অগ্রগতিতে কোনোক্রমে কম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। বিশেষত অনেকেই যে আলোকিত এলিটের (অভিজাত) অপেক্ষায় থাকেন, সেই এলিটদের বিকাশ অঙ্কুরে বিনষ্ট হয় দলপুষ্ট সেবানির্ভর বিত্তবানদের নোংরামি ও আগ্রাসী কর্মকাণ্ডে। আমাদের সমাজে ব্যাংক লুটেরাদের ‘দাতা’ হিসেবে আবির্ভাবের দৃষ্টান্ত কম নয়। একই রকমের ছবি সরকারনির্ভর ও নেতানির্ভর সংস্কৃতিতেও দেখা যায়। এমনকি ওষুধ ও টেস্ট কিটকে কেন্দ্র করে সদ্য ঘটে যাওয়া রাজনীতিক অর্থনীতি, করপোরেট জগতে লম্বালম্বি সংযুক্তির ইঙ্গিত দেয়; যা বিশ্বপরিসর পর্যন্ত বিস্তৃত।

শুরুতেই উল্লেখ করেছি যে অদৃশ্য সার করোনা-২ ভাইরাসের আগমনে পুরনো সম্পর্কগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। আক্রান্ত আপনজনকে বাইরে ফেলে রাখার মতো অমানবিক ঘটনা আমি ব্যতিক্রমী মনে করি, যার পেছনে অজ্ঞতা ও ভীতি কাজ করেছে। কেবল (সামষ্টিক) সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্কের প্রতি নজর দিলে কয়েকটি পরিবর্তন উল্লেখযোগ্য। অবস্থাপন্নদের মধ্যকার দয়ালু ব্যক্তিরা আগের মতো রাস্তাঘাটে সাহায্যের হাত বাড়াতে পারেন না। প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও অস্থায়ী গৃহকর্মীদের বাসায় আসতে দিতে এখন অনেকেই দ্বিধান্বিত। তারা নিজেদের বাসা থেকে এসে কাজ করেন বিধায় অনেকেই সংক্রমণের আশঙ্কা করেন। একই শঙ্কা গাড়ির চালকের জন্যও প্রযোজ্য এবং কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যুতে অধিকসংখ্যক ব্যক্তি সেবাকর্মীর ওপর নির্ভরশীলতা দূর করার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন। নিজ বাসায় গাড়ির চালক বা গৃহকর্মী রেখে সেবাপ্রাপ্তি চালু রাখার সামর্থ্য অধিকাংশ মধ্যবিত্তের নেই। ব্যতিক্রম দেখা যায় অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের নিরাপত্তাকর্মীদের ক্ষেত্রে। অনেকেই, বিশেষত অনভিপ্রেত ঘটনার আশঙ্কায় তাদের জন্য নিজ প্রাঙ্গণে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছে; যা তাদের স্বাধীনতা কমালেও সাশ্রয় এনেছে। কিছুটা ভিন্ন হলেও অফিস-আদালতে নিম্ন আয়ের কর্মচারীদের কাছ থেকে স্বল্প দূরত্ব থেকে সেবা নিতে অবস্থাপন্নরা দ্বিধাবোধ করবেন। পেপারবিহীন ও শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করে দাপ্তরিক কাজ সম্পাদনের সরকারি নির্দেশ কোনো একদিন কার্যকর হলে হয়তো নিম্ন আয়ের অনেকেই নতুন প্রযুক্তি-পরিবেশে অবাঞ্ছিত হয়ে পড়বেন। কভিড-পরবর্তী সমাজ যে অধিক প্রযুক্তিনির্ভর এবং কম মাত্রায় অদক্ষ শ্রমনির্ভর হবে, তা অনেকেই স্বীকার করেন। তবে সেই পর্যায়ে পৌঁঁছানোর আগেই হয়তো নতুন ভাইরাসের কারণে বাইরে থেকে আসা গৃহকর্মীদের মতো অনেক নিম্ন আয়ের ও স্বল্প দক্ষতার অফিসকর্মী কর্ম অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হবেন।

আমার জানামতে, অনেক বাসাতেই খণ্ডকালীন গৃহকর্মীদের বেতন দেয়া হচ্ছে। এর পেছনে মানবিক কারণ যেমন রয়েছে আবার অনেকেই অতীতের স্বাভাবিক জীবনে ফিরবেন আশা করে বিশ্বস্ত সেবাকর্মীদের ধরে রাখতে চান। একইভাবে বহু বেসরকারি অফিস, শোনা যায় আংশিক হলেও কর্মচারীদের বেতন দেয়া অব্যাহত রেখেছে। ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের একটি সদ্য সমাপ্ত গবেষণা থেকে জানা যায়, এই চর্চা বড়জোর সেপ্টেম্বর অবধি চালিয়ে নেয়া সম্ভব হবে এবং অর্ধেকেরও বেশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্তমান পরিস্থিতি গড়ালে কী হবে ভাবতেই পারছে না। তবে টিকে থাকার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মপদ্ধতিতে ও নিয়োগ নীতিতে পরিবর্তন আনতে উদ্যোগ নিয়েছে।

উপরের বর্ণনা থেকে অনুধাবনযোগ্য যে অদৃশ্য ভাইরাসটি আমাদের সামাজিক ও অর্থনীতিক প্রতিষ্ঠানের একটি অতি পুরনো সম্পর্কে আঘাত হেনেছে। সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে এ সম্পর্কটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থেকেছে। এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে ব্যক্তি খাতের অপারগতায় অথবা প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তরের ফলে পুরনো মনিব (নিয়োগকারী)-সেবাকর্মীর সম্পর্ক ভেঙে গেলে সরকারের ওপর সামাজিক নিরাপত্তার দায়ভার অধিক বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে এটাই উপযুক্ত সময়, সমাজ ও অর্থনীতিক সংগঠনের গুণগত পরিবর্তন আনার, যা পরবর্তীতে সামাজিক সম্পর্ককে সম্মানজনক অবস্থানে নিতে পারবে। এই উভয় সংকট বিশিষ্ট জন ও নীতিনির্ধারকদের মাঝে স্বীকৃত হলেই সমাধানের সম্ভাব্য পথ নিয়ে আলোচনা অর্থবহুল হবে। সাধারণভাবে উল্লেখ করব যে ব্যক্তি স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য দেয় সেবার মান ও দাম বৃদ্ধি পেলে সে কাজে পেশাদারিত্ব আসবে এবং সম্পর্কের সম্মানজনক রূপান্তর ঘটবে। এ খাত থেকে ঝরে পড়া শ্রমিককে সমষ্টির উন্নয়নকর্মে (যেমন নদী খনন) নিযুক্ত করার সুযোগ প্রশস্ত করতে হবে। আশা করব বিভ্রান্ত না হয়ে অথবা করপোরেট স্বার্থের বেড়াজালে আটকে না পড়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব উন্মুক্তমনা পেশাদারিত্বকে অঙ্গীভূত করে সমাজ ও অর্থনীতিকে এগিয়ে নেবেন।

[মতামত লেখকের নিজস্ব এবং সে মতের সঙ্গে ইআরজির অন্যদের মতের অভিন্নতা না-ও থাকতে পারে।]

ড. সাজ্জাদ জহির: নির্বাহী পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ

 

Download

 

1438