বণিক বার্তা |
মে ২১, ২০২৩ |
সম্পদকে ঘিরে নানা ধরনের কর থাকতে পারে। আশু প্রয়োজন (অর্থাভাব) মেটাতে সরকার যেকোনো সময় সম্পদশালীদের ওপর এককালীন কর আরোপ করতে পারে। তবে আলোচনায় প্রাধান্য পায় নিয়মিত বার্ষিক (সম্পদ) কর। প্রথম পর্বে (সম্পদ কর: জানা কথার পুনরাবৃত্তি) এটাও উল্লেখ করেছি যে সম্পদ ও আয় উভয়কেই গুনতিতে এনে কর ধার্যের চল রয়েছে। যেমন অধিক আয়ের ব্যক্তির সম্পদের ওপর করারোপ অথবা অধিক সম্পদের মালিকের আয়ের ওপর অধিক মাত্রায় কর (সারচার্জ) আরোপ। সাধারণভাবে সবক্ষেত্রে সম্পদ বলতে নিট সম্পদকে গণ্য করা হয়। শুধু তা-ই নয়, উদ্দেশ্যের হেরফেরে, কর নির্ণয়কালে, কিছু সম্পদ গণনায় নেয়া হয়, আবার অনেক আয়করি সম্পদকে (সম্পদ) করের আওতার বাইরে রাখা হয়, বিশেষত যদি সেই সম্পদ থেকে প্রাপ্ত আয়ের ওপর ভিন্নভাবে (আয়) কর গণনা হয়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সম্পদ করের উদ্ভব ও যৌক্তিকতার প্রাথমিক জ্ঞান পেতে নবরু তানাবের রচিত ‘দ্য ট্যাক্সেশন অব নেট ওয়েলথ’ শীর্ষক নিবন্ধটি বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য (১লা জানুয়ারি, ১৯৬৭, https://www.elibrary.imf.org/view/journals/024/1967/001/article-A005-en.xml)। ক্যালডর কমিশনের পরামর্শের ভিত্তিতে ১৯৫৭ সালে ভারত ও শ্রীলংকায় সম্পদ কর প্রবর্তিত হয়েছিল। [Nicholas Kaldor, Indian Tax Reform, Department of Economic Affairs (New Delhi, 1956), pp. 19-28, and Suggestions for a Comprehensive Reform of Direct Taxation, Government of Ceylon (Colombo, 1960), pp. 13-14.] তথ্যমতে, ভারতে শুরুতে নির্বিচারে সব সম্পদের ওপর কর আরোপ করা হতো। ১৯৯৩ সালে চেলিয়াহ কমিটির পরামর্শে আইনে ব্যাপক সংশোধনী আনা হয়। পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে সমতা আনার চিন্তা থেকে বেরিয়ে অনুৎপাদনশীল খাতে সম্পদ সৃষ্টি নিরুৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে করযোগ্য নিট সম্পদকে পুনর্নির্ধারণ করা হয়। সংগত কারণে তালিকা সংকুচিত হয়ে অলংকার, সোনা-রুপার বুলিয়ন, দামি আসবাবপত্র, বিলাসবহুল গাড়ি, অব্যবহৃত জমি ইত্যাদিতে আটকে পড়ে। সম্ভাব্য সব করদাতার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে এসব সম্পদের ভিত্তিতে আদায়কৃত রাজস্বের পরিমাণ হ্রাস পায়। এক পর্যায়ে সংগৃহীত রাজস্বের তুলনায় খরচ অধিক হওয়ায় এ করের প্রতি রাজস্ব বিভাগের আগ্রহে ভাটা পড়ে। তাই ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ভারতে ১৯৫৭-এর সম্পদকর আইন কার্যত বাতিল করা হয়। নতুন আইনে (২০২২ সালে সংশোধিত), ‘অতিধনী’ (সুপার রিচ)-দের আয়ের ওপর সারচার্জ ২ থেকে ১২ শতাংশে উন্নীত করা হয়। যাদের বার্ষিক আয় ১ কোটি রুপির অধিক তাদের ‘অতিধনী’ আখ্যা দেয়া হয়। সারচার্জের বাইরে ৩০ লাখ টাকার অধিক নিট সম্পদমূল্যের ওপর ১ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হয়। অবশ্য নিট সম্পদমূল্য গণনায় কেবল অনুৎপাদনশীল সম্পদকে (দ্রব্য বা স্থাবর সম্পত্তি) অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
প্রায় একই ধারায় পাকিস্তানের সম্পদ কর আইনে পরিবর্তন এসেছে। সরকারি অবস্থান অনুযায়ী, বর্তমানে নিট সম্পদমূল্যের ওপর কোনো কর আরোপ হয় না। তবে স্থাবর সম্পত্তির মূল্যায়িত বার্ষিক আয়ের ওপর ২০ শতাংশ হারে করারোপের ব্যবস্থা রয়েছে। এবং অবাক হওয়ার নয় যে স্থায়ী সম্পদের অবচয়মূল্য যেভাবে নির্ধারণ করা হয়, তেমনি যান্ত্রিকভাবে সম্পদমূল্যের ৫ শতাংশ সমান অর্থকে বার্ষিক আয় গণ্য করা হয়। অর্থাৎ হিসাবের নানা পথ ঘুরে অনুৎপাদনশীল নিট সম্পদের ওপর ১ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে। কিছুটা ভারতের মতো এ করের আওতাধীন সম্পদের তালিকা থেকে অনেকগুলো স্থাবর সম্পত্তি বাইরে রাখা হয়েছে। যেমন প্রত্যেকের একটি করে সম্পত্তি করবহির্ভূত রাখা হয়, যে সম্পত্তির (বাসা-বাড়ির) আয় প্রদর্শন করে আয়কর দেয়া হচ্ছে, তা ভিন্নভাবে উল্লিখিত গণনার আওতায় আসবে না ইত্যাদি। ফেলে রাখা জমির ওপর সদ্য সংশোধিত (২০২২) আইনে কর প্রবর্তন করা হলেও নির্দিষ্ট জমিতে বসতি তৈরিতে সময় প্রয়োজন বিধায় মধ্যবিত্তদের মাঝে সেই জমির ওপর কর গুনতে আপত্তি রয়েছে।
আয়করের বাইরে সম্পদের ওপর কর আরোপের বেশকিছু যুক্তি দেখানো হয়। অনেকে সক্ষমতার ভিত্তিতে ব্যক্তি বা সংস্থার ওপর কর আরোপ করায় বিশ্বাসী। তারা মনে করেন যে কেবল আয় দিয়ে সক্ষমতা যাচাই করা যায় না। যেহেতু সম্পদের মালিকানা সক্ষমতার একটি বড় মাপকাঠি, তাই তারা মনে করেন যে সম্পদের ভিত্তিতে অতিরিক্ত কর আদায় করা উচিত। এর সঙ্গে যুক্ত হয় মুষ্টিমেয়দের হাতে সম্পদের কেন্দ্রীভূতকরণ ও তার কুপ্রভাব ঠেকানোর আকাঙ্ক্ষা ও সমতাকামী মানুষের মাঝে সম্পদ পুনর্বণ্টনের চাহিদা মেটানোর তাগিদ। তবে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে এটা স্পষ্ট যে সম্পদের ওপর কর আরোপ করে সম্পদের পুনর্বণ্টন সম্ভব নয়। ভূমি মালিকানায় আমূল সংস্কার আনা বা দরিদ্র কৃষকের হাতে সেচযন্ত্র জাতীয় সম্পদ হস্তান্তর একসময় কিছুটা সহজ থাকলেও মধ্যস্বত্বভোগীর উপস্থিতিতে সম্পদ করের মাধ্যমে আর্থসামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠা কল্পনাতীত। সম্ভবত সেসব কারণে তৃতীয় একটি যুক্তির আড়ালে উপমহাদেশের অন্যান্য দেশে সম্পদ কর আইনে সংশোধনী এসেছে মূলত অনুৎপাদনশীল সম্পদে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক সঞ্চয়কে আটকে রাখাকে নিরুৎসাহিত করতে। লক্ষণীয় যে সঞ্চিত এসব সম্পদ (স্বর্ণালংকার, পতিত জমি ইত্যাদি) থেকে কোনো আয় হয় না, তাই আয়কর দিতে হয় না। সেই যুক্তিতে সেসব সম্পদ থেকে সম্ভাব্য আয় নিরূপণ করে তার ওপর কর ধার্য করা হয়। উপমহাদেশে সম্পদ কর আইনের সংশোধনীর ধারা দেখলে শেষোক্ত কারণটি মুখ্য হতে দেখা যায়।
উল্লিখিত প্রবণতা সত্ত্বেও থমাস পিকেটির ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি গ্রন্থটি ইংরেজিতে (২০১৪) প্রকাশের পর আজ বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের অনেকেই মনে করেন যে পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থায় সম্পদ (যা পুঁজির বিকল্প অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে) মালিকানায় বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। পিকেটির মতে, শ্রমের মাধ্যমে সৃষ্ট না হয়ে পুঁজি যখন উত্তরাধিকার বা বিবাহসূত্রে প্রাপ্ত হয়, তখন সমাজের অবক্ষয় অবধারিত। সমাজে বৈষম্য বৃদ্ধির এই প্রবণতা রোধ করার জন্য পিকেটি করনীতি পরিবর্তনের সুপারিশ করেন। বিশেষত আর্থিক সম্পদ ও উত্তরাধিকার বা বিবাহসূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের ওপর কর আরোপের ওপর তিনি গুরুত্ব দেন। অঞ্চলভিত্তিক সম্পদ করের উল্লেখ করলেও সম্পদ করের প্রায়োগিক সমস্যার কারণে তিনি ‘অতিধনী’দের বাড়তি আয় বন্ধ করার উদ্দেশ্যে (রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে নয়) নির্দিষ্ট সীমার অধিক আয়ের ওপর ৮০ শতাংশ কর আরোপের সুপারিশও করেন।
পিকেটি যেমন জাতীয় পর্যায়ে সম্পদ কর আরোপের অকার্যকরতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, তেমনি তিনি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিসরে একীকরণের (ইন্টেগ্রেশন) নামে বাজার সম্প্রসারণের অশুভ সম্ভাবনা সম্পর্কেও সতর্ক করেন। পুঁজি ও আয়ের ওপর তিনি এবং তার সহকর্মীরা যে ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন, তা থেকে পিকেটির মূল উপসংহার ছিল: পুঁজি বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্তির হার (রেট অব রিটার্ন অন ক্যাপিটাল) যদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হারের চেয়ে অধিক থাকে, পুঁজির মালিকানায় বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে, যা পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বিপর্যয় আনবে। আবারো পিকেটির বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করব, রাজস্ব বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নয়, পুঁজির ওপর মুষ্টিমেয়র ক্রমবর্ধমান আধিপত্য রোধ করার উদ্দেশ্যেই কর আরোপের পরামর্শ। লক্ষণীয় যে পুঁজি ও সম্পদ অনেক ক্ষেত্রে সমার্থে ব্যবহার হয়েছে, যা প্রয়োগের সময় ভিন্নভাবে দেখা জরুরি। সর্বোপরি, আন্তঃদেশীয় বৈষম্যকে এড়িয়ে সরলীকৃত প্রবণতা ও তা থেকে টানা উপসংহার ও নীতি পরামর্শ বাংলাদেশের মতো স্বল্প পুঁজির ও প্রযুক্তিতে পিছিয়ে পড়া দেশের জন্য কতখানি প্রযোজ্য তা যাচাই করে দেখা প্রয়োজন।
গবেষণার ফল কীভাবে ব্যবহার হবে তা গবেষকদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। সম্ভবত সে কারণেই স্থান-কালের প্রাসঙ্গিকতা ভুলে কেউ কেউ ভিন্ন স্বার্থে সম্পদ কর আরোপের প্রচারণায় নামেন। নেটের দুনিয়া ঘাঁটতে গিয়ে এমনই একটি পুস্তিকা আমার নজরে এল। প্রকাশনী তারিখ ছাড়া “An annual tax on the world’s multi-millionaires and billionaires: What it would raise and what it could pay for: Factsheet Report” শীর্ষক পুস্তিকাটি প্রকাশ করেছে চারটি প্রতিষ্ঠান—অক্সফাম, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্যাট্রিয়টিক মিলিয়নেয়ার ও ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিস এবং ফাইট ইনইক্যুয়ালিটি মোর্চা, যা অক্সফাম, মানবাধিকার কমিশন ইত্যাদি বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত)। বিভিন্ন দেশের তথ্য দিয়ে পুস্তিকাটিতে সহজ অংকে সম্পদ কর থেকে সম্ভাব্য অর্থ সংগ্রহের পরিমাণ এবং সেই অর্থ স্বাস্থ্যসেবা খাতে অথবা দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যবহার করার প্রস্তাব রয়েছে। সেখানে উল্লেখ রয়েছে যে বাংলাদেশে ২০২১ সালে ৫ কোটি ডলারের (৫০০ কোটি টাকার) অধিক সম্পদ ছিল ১৯৫ জন ব্যক্তির। ৫ থেকে ৫০ মিলিয়ন ডলারের সম্পদধারীদের ওপর ২ শতাংশ এবং ৫০ মিলিয়ন ডলারের অধিক সম্পদধারীদের ৩ শতাংশ হারে কর ধার্য করে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার কর আদায় প্রাক্কলন করা হয়েছে।
উল্লিখিত প্রচারণা এবং সেই সঙ্গে আইএমএফের কর রাজস্ব (জাতীয় উৎপাদনের শতাংশ) বৃদ্ধির চাপ আমাদের মতো দেশে কর প্রশাসনের আশু পরিবর্তন থেকে নজর সরিয়ে সম্পদ করের বিভ্রান্তিকর জালে আবদ্ধ করতে পারে। তাই দেশপ্রেমী নীতিনির্ধারকদের দেশে-বিদেশে এ-সংক্রান্ত নানা উদ্যোগ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য বাজেটের রাজনীতি-অর্থনীতিতে না গেলেও প্রযুক্তিতে পিছিয়ে পড়া দেশে পুঁজি গঠনের প্রচেষ্টার সঙ্গে করনীতি যেন সাংঘর্ষিক না হয়, তা নিশ্চিত করা জরুরি। সেই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন যে অর্থ পাচার ও দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ নিয়ে ভিন দেশে সম্পদ গড়ে তোলার প্রবণতা রোধ না করে অভ্যন্তরীণ সম্পদের ওপর কর আরোপ কি পিকেটির বিশ্লেষণের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ? নিঃসন্দেহে বৈষম্য দূর করা মানবকল্যাণ ও সমাজের অটুটতার জন্য জরুরি। তবে সঠিক পথ নির্ণয়ের জন্য এ দেশে বৈষম্যের কারণ অনুসন্ধান প্রয়োজন। এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের সম্পদ ও আয়ের ওপর কর আরোপের যৌক্তিকতা যেমন খুঁজে পেতে হবে, তেমনি এ দুটোর ওপর উপযুক্ত কর মিশ্রণ নির্ধারণ করতে হবে। বিশ্বপরিসরে নতুন বাজার ব্যবস্থাপনার আলোকে দেশীয় পর্যায়ে করনীতির এসব দিক আগামী পর্বে আলোচনা করব।
[এ নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব।]
ড. সাজ্জাদ জহির: ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক
Source: https://bonikbarta.net/home/news_description/341112/%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A6%A6-%E0%A6%95%E0%A6%B0:-%E0%A6%AF%E0%A7%8C%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%87-%E0%A6%AA%E0%A7%87%E0%A6%9B%E0%A6%A8%E0%A7%87-%E0%A6%AB%E0%A7%87%E0%A6%B0%E0%A6%BE
1861