পশ্চিমের জনস্রোত বিভিন্ন সময়ে (সহস্রাব্দীতে) ঘটেছে এবং ভিন্ন সময়ে আসা (উপমহাদেশের উত্তর ও পশ্চিমে বসতি নেয়া) জনগোষ্ঠীর (প্রাতিষ্ঠানিক) ধর্ম বিশ্বাসে ভিন্নতা থাকলেও ভাষায় প্রায় অভিন্নতা লক্ষণীয়। ঋগবেদের মাধ্যমে যে জ্ঞানের ভাণ্ডার সংস্কৃত ভাষায় এল, তাতে হিন্দু ধর্মের উল্লেখ ছিল না। তবে এটা অনুমেয় যে উপমহাদেশের বিজিত জনগোষ্ঠীর সংস্পর্শে এসে যে সামাজিক স্তরবিন্যাস সৃষ্টি হয়, তার প্রকাশ ঘটে ধর্মীয় অনুশাসনকে সুসংহত করার মাঝে (খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে রচিত মনু-স্মৃতি বা মনু সংহিতা দ্রষ্টব্য)। আজ সবাই জানেন যে হিন্দি ও উর্দুর মাঝে পার্থক্য অতি নগণ্য। অনুমান করা হয় যে একই ভাষার বাহকরা অভিবাসনের দুটো পথ গান্ধার, আফগানিস্তান (কম্বৌজ) এবং সিরিয়া-ইরান বেছে নেয়ায় এবং পরবর্তীতে হিন্দিতে সংস্কৃতর (নাগরী লিপির) প্রভাব ও উর্দুতে ফারসি লিপির প্রভাব পড়ায় কথনে ও লেখনে দুটো (আপাত) ভিন্ন উপধারা জন্ম নেয়।
আদি পশ্চিমা সম্প্রসারণের আগে থেকে প্রাচীন বাংলা, অসমীয় ও উড়িয়া ভাষার স্বতন্ত্র রূপ ছিল বলে ধারণা করা হয়। তবে গঙ্গা-পদ্মা, যমুনা-ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনার অববাহিকার সমতলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর আদি ভাষা বাইরে থেকে আসা ভাষার অভিযোজনে এলাকাভিত্তিক কথ্যভাষায় তারতম্য এনেছে বলে অনুমেয়।
রাষ্ট্রীয় পোষণে যে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠবে তার দার্শনিক ভিত নির্ণয়ের ক্ষেত্রে জাতিসত্তা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের যেকোনো একটিকে মুখ্য হিসেবে বেছে নেয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। এ বিষয়ে চটজলদি কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত না হয়ে আমাদের আত্মপরিচয় নির্ণয়ে বিভিন্ন জটিলতার দিকগুলো সম্যক উপলব্ধিতে আনা প্রয়োজন। মোটাদাগের প্রেক্ষিতটা ২০২১ সালের ২৮ এপ্রিল বণিক বার্তায় প্রকাশিত ‘আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনার সংহতিকালে দুর্বল দেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ নিবন্ধে পাওয়া যাবে। সেই আঙ্গিকে বিভিন্ন স্তরে পরিচয় চিহ্নিত করার সম্ভাবনা গুনতিতে নিয়ে জাতিসত্তা, ধর্ম বিশ্বাস ও ভাষা নিয়ে আরো কয়েকটি দিক উল্লেখ করব।
(১) পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তি এবং তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা এ উপমহাদেশের জনগোষ্ঠীকে তিনটি ধর্মে ভাগ করে দেখতে (এবং দেখাতে) চেয়েছিল, হিন্দু, মুসলমান ও শিখ (বিবিসিকে ১৯৫৫ সালে আম্বেদকারের সাক্ষাৎকারে তার স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে)। ভাবতে অবাক লাগে যে আগের ভাবধারায় প্রভাবান্বিত এবং স্পষ্টতই ব্রাহ্মণবাদকে খণ্ডন করে বিকশিত সাম্যবাদী/সমতাকামী (ঋষভ-মহাবীরের) জৈন ধর্ম এবং গৌতম বুদ্ধ প্রবর্তিত বৌদ্ধ ধর্ম, সেই তালিকায় স্থান পায়নি। কার্যত পশ্চিমা শক্তি বিভিন্ন জাতিসত্তা ও ভাষাকে দলিত করে (উপনিবেশ-পরবর্তী সংবিধানে), ইংরেজি ছাড়া (ইন্ডিয়া-পাকিস্তান দেশভেদে) হিন্দি ও উর্দু ভাষাকে সব জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। সেই আলোকে বাংলাদেশের ইতিহাস পাঠে ভাষা আন্দোলনের এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের সুদূরপ্রসারী (পশ্চিমা আধিপত্যবিরোধী) তাৎপর্য অনুধাবন জরুরি।
(২) জাতিসত্তাকেন্দ্রিক আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দুটো দুর্বলতা রয়ে গেছে—ক. সমধর্মী অন্যান্য জাতিসত্তা ও ভাষার সঙ্গে মেলবন্ধন গড়ে তুলতে ব্যর্থতা, বিশেষত অসমীয়া ও উড়িয়া ভাষার সঙ্গে খ. চাপিয়ে দেয়া ভৌগোলিক সীমানার কারণে কোনো কোনো জাতিসত্তার একাংশ বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে (আন্তঃসীমান্তীয় জনগোষ্ঠী) এবং একই সঙ্গে, অনেক ক্ষুদ্র আকারের জাতিসত্তা রয়েছে যারা (সম্ভবত) আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য যথেষ্টভাবে সংঘটিত নয়। সীমান্তের উভয় পাড়ে বসবাসরত এসব জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্মানজনক সমঝোতা স্থাপন করার ক্ষেত্রে প্রচণ্ড ঘাটতি রয়ে গেছে।
(৩) মানুষ সমাজবদ্ধ হওয়ার শুরু থেকে যেমন জাতিসত্তা গঠনের ও ভাষার যাত্রা শুরু, একইভাবে সামাজিক রীতি, আচার-আচরণ এবং সামষ্টিক বিশ্বাসবোধ দানা বাঁধতে শুরু করে। কিন্তু স্থানীয় এবং আঞ্চলিক বিশ্বাসবোধ এক বা একাধিক ধর্ম হিসেবে আবির্ভূত হয় যখন সাম্রাজ্যে স্থিতি আনতে বিভিন্ন জাতিসত্তার মাঝে সহাবস্থানের সাধারণ নীতিমালা নৈতিক ও ধর্মীয় বিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। তারই আলোকে যে ধর্মাবলম্বীই হোক না কেন, সময়কালের ব্যবধান ছাড়া, পশ্চিম থেকে আসা শাসকদের উৎপত্তি ও চরিত্রগত দিকে খুব বেশি অমিল পাওয়া যায় না। অনেকে অবশ্য মনে করেন যে দুটো পর্বেই যা প্রথমে সাম্যবাদের ধারণা ও জ্ঞানের ভাণ্ডার নিয়ে এসেছিল, তা পরবর্তী সময়ে বিজিত গোষ্ঠীর অসহায়তার সুযোগ নিয়ে রক্ষণশীল ধ্যান-ধারণার ধারক-বাহকে পর্যবসিত হয়।
পরিশেষে বলব, ওপরের বর্ণনা নির্দিষ্ট ভূসীমা ও তার পশ্চিম থেকে আসা জনগোষ্ঠীকে নিয়েছিল। কিন্তু এদের বাইরেও আরো পশ্চিমে ও পূর্বে অনেক জাতিগোষ্ঠী রয়েছে এবং সেখানকার শাসকগোষ্ঠীরা এ উপমহাদেশে তাদের আধিপত্য বিস্তারে আগ্রহী থাকবে। এ বিশাল অঙ্গনে আমাদের স্থান খুঁজে পেতে হলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় স্থাপনের মাধ্যমে অতীতে পশ্চিম থেকে আসা শাসকগোষ্ঠীর ধর্মান্ধ অংশকে পরিশীলিত করা জরুরি। বিভিন্ন জাতিসত্তার মাঝে সম্মানজনক সহাবস্থান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব, যা সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। তাই নতুন প্রজন্মকে তাদের জাতি পরিচয় ও সংকরত্ব অর্জনের ইতিহাস জানতে উৎসাহিত করা প্রয়োজন এবং সে ব্যাপারে ব্যক্তি পর্যায়ে শেষ সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব তাদের হাতেই ছেড়ে দেয়া আবশ্যিক। তাই শিক্ষাক্রমে ধর্মান্ধতা বাদ দিয়ে যেমন ধর্মের নির্যাস তুলে ধরা প্রয়োজন, তেমনি ব্যক্তিপূজা বর্জন করে জাতিসত্তা ও বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বিকাশের ইতিহাস তুলে ধরা জরুরি।
ড. সাজ্জাদ জহির অলাভজনক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের (ইআরজি) নির্বাহী পরিচালক। এর আগে তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়া তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন বিশ্বব্যাংক, আইএফসি, আইএফএডি, ইউনিসেফ, এফএও ও ডব্লিউএফপির মতো প্রতিষ্ঠানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করে পিএইচডি করেছেন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোতে। সাক্ষাৎকার: সাবিদিন ইব্রাহিম। শ্রুতলিখন: দিদারুল হক
Source: https://bonikbarta.net/home/news_description/375323/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%89%E0%A6%AA%E0%A6%AF%E0%A7%8B%E0%A6%97%E0%A7%80-%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AE%E0%A6%B6%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF-%E0%A6%97%E0%A7%9C%E0%A7%87-%E0%A6%A4%E0%A7%8B%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%9A%E0%A7%87%E0%A7%9F%E0%A7%87%E0%A6%93-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%97%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%AA%E0%A7%82%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A3-%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%AD%E0%A7%82%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%BE-%E0%A6%B0%E0%A7%9F%E0%A7%87%E0%A6%9B%E0%A7%87