ড. সাজ্জাদ জহির |
দৈনিক বণিক বার্তা |
সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২২ |
শ্রদ্ধাঞ্জলি |
গণতন্ত্র চর্চা: আমার স্মৃতিতে আকবর আলি খান
গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনভিত্তিক সংসদীয় ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হলে আমি যেমন বিব্রত বোধ করি, তেমনি আমার প্রতিক্রিয়া শুনে প্রশ্নকর্তাও বিব্রত বোধ করেন। কাল্পনিক (ইউটোপিয়ান) সমাজতন্ত্র সম্পর্কে অনেক আলোচনা হয়েছে, কিন্তু গণতন্ত্র ধারণায় কাল্পনিকতার উপস্থিতি নিয়ে আমরা নীরব থাকি। আমি মনে করি, রাজনীতির অঙ্গনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা তখনি সম্ভব যখন ব্যক্তি, পরিবার ও গোষ্ঠী পর্যায়ে গণতন্ত্র চর্চা অভ্যাসে পরিণত হয়। অস্বীকার করব না সামষ্টিক পর্যায়ে সু-ব্যবস্থা না থাকলে ক্ষুদ্র পর্যায়ে গণতন্ত্র চর্চা নিশ্চিত করা যায় না। তবে সে ‘সু-ব্যবস্থা’র নির্দিষ্ট রূপ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এমনকি ক্ষুদ্র পর্যায়ে গণতন্ত্র চর্চার প্রকাশ কী হতে পারে, আমার জানা মতে তারও কোনো সর্বজনগৃহীত মাপকাঠি নেই। সদ্যপ্রয়াত ড. আকবর আলি খানের সঙ্গে আমার সংযোগ সীমিত পরিসরের। স্মৃতি থেকে তার চর্চার কয়েকটি দিক তুলে ধরব, যা হয়তো সে মাপকাঠিকে অবয়ব দিতে পারবে।
আমাদের মাঝে অনেকেই যারা গণতন্ত্রী হিসেবে জনসমক্ষে সমাদৃত তাদের ব্যক্তি পর্যায়ে ঘাটতি দেখা যায়। গণতন্ত্র চর্চার এ অভাব প্রকাশ পায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ, তা লিপিবদ্ধ করা এবং প্রচারের সচরাচর গৃহীত পদ্ধতিতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো প্রস্তাবের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত থাকলে তা সিদ্ধান্ত আকারে গৃহীত হয়। সবাই সম্ভবত স্বীকার করবেন, নানা উপায়ে সদস্যদের মতকে প্রভাবান্বিত করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সম্ভব। নির্বাচনী অর্থ ব্যবহার, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ ইত্যাদি সে প্রভাব হ্রাসের নামে আলোচনায় আসে, যা দিবাস্বপ্ন বললে অত্যুক্তি হবে না। গণতন্ত্র চর্চার অভাবের মূল দুটি দিক উপেক্ষিত রয়ে যায়। এক. সংখ্যাগরিষ্ঠ সিদ্ধান্তের পক্ষে যারা মত দেননি, তাদের অভিমত ও তার পেছনে যুক্তি লিপিবদ্ধ না করা। দুই. বৃহত্তর গোষ্ঠীর মাঝে নিজেদের নানা মতের উপস্থিতি প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকা। পরিবার, প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতির সব অঙ্গনে এ দুটি চর্চার অভাব নিদারুণ পরিলক্ষিত হয়। অথচ প্রয়াত আকবর আলি খানের স্বাভাবিক চর্চার মাঝে এগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে জেনেছি, ভিন্ন মত প্রকাশের ক্ষেত্র নিশ্চিত করা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সে মতকে লিপিবদ্ধ করার সুযোগ দেয়া এবং তথ্য ও যুক্তিভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া পৃষ্ঠপোষকতা করা।
মাত্র দুবার ড. আকবর আলির সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছিল, প্রয়াত অর্থমন্ত্রী শাহ মোহাম্মদ কিবরিয়ার পরামর্শক কমিটির সদস্য হিসেবে ও রেগুলেটরি রিফর্ম কমিশনের (রেরিক) সদস্য থাকাকালীন।
পরামর্শক কমিটির এক বৈঠকে মন্ত্রী ডলারে সরকারি বন্ড বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের প্রস্তাব দিলেন। অনেকের নীরবতার মাঝে জনৈক সদস্যের বিরোধিতায় যুক্তি থাকায় ড. আকবর আলি খান প্রাথমিক অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। এমনকি পরবর্তী সময়ে বন্ডের বিপক্ষে অভিমত দিয়ে প্রতিবেদনটি পেশ করা হলে, মন্ত্রীর ভিন্নমত থাকা সত্ত্বেও ড. আকবর আলি খান যুক্তি ও তথ্যের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। বন্ডের পক্ষে মত গ্রহণ করা হয়নি। প্রস্তাবনাটি আর কার্যকর হয়নি বলে জেনেছি।
দ্বিতীয় অভিজ্ঞতাটি আরো বিচিত্র। নির্বাচন শেষে নতুন সরকার ২০০৯ সালের শুরুতে যাত্রা শুরু করে। রেরিকের চেয়ারম্যান ড. আকবর আলি নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ না পেয়ে সব কার্যক্রম লিপিবদ্ধ করে প্রধানমন্ত্রীকে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়ার উদ্যোগ নেন। একদিন সে প্রতিবেদনে স্বাক্ষর নেয়ার জন্য রেরিকের পক্ষ থেকে একজন আমার অফিসে এলেন। একটি সিদ্ধান্তের পক্ষে আমার মত ছিল না, অথচ সেই প্রতিবেদনে একটি বৈঠকের সিদ্ধান্ত হিসেবে তা অন্তর্ভুক্ত দেখতে পাই। ফোনে আমার অভিমত জানালে ড. আকবর আলি খান তাত্ক্ষণিক আমাকে এক পৃষ্ঠায় আমার দ্বিমত ও তার কারণগুলো লিখে দিতে বলেন। প্রতিবেদনে সিদ্ধান্তটির বিরুদ্ধ মত হিসেবে তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আগেই আভাস দিয়েছি, আমাদের দেশে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে গণতন্ত্র চর্চার অভাব অপরিসীম। আশা করব, হাজারো আকবর আলি এ দেশে জন্ম নেবেন, যারা ন্যায় ও যুক্তিভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিদেনপক্ষে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র চর্চা করবেন।
সাজ্জাদ জহির: নির্বাহী পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ
sajjadzohir@gmail.com
Source: https://bonikbarta.net/home/news_description/313480/%E0%A6%97%E0%A6%A3%E0%A6%A4%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0-%E0%A6%9A%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%9A%E0%A6%BE:-%E0%A6%86%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A7%83%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%86%E0%A6%95%E0%A6%AC%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%B2%E0%A6%BF-%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A6%A8
2744