কালবেলা |
মতামত /উপ-সম্পাদকীয় |
২৮ জুন ২০২৪ |
ড. সাজ্জাদ জহির |
সাধারণত, ব্যবসা জগতে সিন্ডিকেট বলতে কিছু ব্যবসায়ী-গোষ্ঠীর মধ্যকার জোট-বাঁধাকে বোঝায়। কোনো বৃহৎ আকারের কাজ সম্পাদনের উদ্দেশ্যে, ভিন্নধর্মী পারদর্শিতার সমন্বয় ঘটানোর জন্য, একাধিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সাময়িককালের জন্য ‘সিন্ডিকেট’ গঠন করতে পারে, যা কার্যসম্পাদনের পর বিলুপ্ত হয়। (নির্দিষ্ট ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনায় একটি সাধারণ উদ্দেশ্যে (স্বার্থে) কিছু ব্যক্তি, কোম্পানি, করপোরেশন বা সত্তার একটি স্ব-সংগঠিত জোটকে সিন্ডিকেট নামে সংজ্ঞায়িত করা হয় (ইন্টারনেট সূত্রে)। ক্রেতাদের নিয়ে সিন্ডিকেট গঠন হতে পারে। তবে এই নিবন্ধে কেবল সরবরাহের দিকের সিন্ডিকেট আলোচনা করা হয়েছে।) ভিন্নধর্মী না হওয়ার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ব্যাংকিং খাতে। সেখানে ‘সিন্ডিকেশন’ এর মাধ্যমে কয়েকটি ব্যাংক একত্র হয়ে সিন্ডিকেট গঠন করে, যার পক্ষে বৃহৎ অংকের প্রকল্প-ঋণ দেয়া সম্ভব। এই ব্যবস্থার ফলে ঋণ দেয়ার ঝুঁকির দায়ে অনেকের অংশীদারত্ব থাকে এবং একক পর্যায়ে ঝুঁকি কম হয়।
এসব দৃষ্টান্তে সিন্ডিকেট নামক জোট-গঠনকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে, এবং সুষ্ঠু সরবরাহ নিশ্চিত করতে সিন্ডিকেটের ভূমিকার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। একইভাবে, যে কোনো বাজারে, সীমিত সংখ্যক উৎপাদক বা সরবরাহকারীদের আন্তঃসমন্বয়কারী সংস্থা, বিধিসম্মত লেনদেন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। অর্থাৎ, বাজারের ক্রীড়কদের আচরণ বিধিসম্মত কিনা তা নিশ্চিত করায় নিযুক্ত সংস্থার (অর্থাৎ, রেগুলেটর-এর) (ইংরেজি শব্দ ‘রেগুলেটর’ এর বাংলা রূপান্তর হিসেবে নিয়ন্ত্রক (অর্থাৎ, কন্ট্রোলার) শব্দটি ধারণাগত ভাবে বেমানান। বিধি-পালন নিশ্চিতকারী সংস্থা অতি দীর্ঘ হওয়ার কারণে রেগুলেটরি সংস্থাকে ‘বিধি-সংস্থা’ নামে আখ্যায়িত করবো।) কাজকে সহজ করতে সিন্ডিকেট ও সিন্ডিকেট-সম ব্যবসায়ী সংগঠনের সম্ভাব্য ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে।
সিন্ডিকেট গঠনের পেছনে অনেকক্ষেত্রে ভালো উদ্দেশ্য থাকলেও এটা অনস্বীকার্য যে, সিন্ডিকেট গঠনের ফলে সৃষ্ট গোষ্ঠীক্ষমতা অনেক সময় বাজারব্যবস্থার কল্যাণমুখী অবদানকে খর্ব করে। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট কোন বাজারে, ক্ষুদ্রস্বার্থের পক্ষে আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে গুটিকতক সংস্থা সিন্ডিকেটে জোটবদ্ধ হতে পারে, অথবা স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠা জোটকে (সিন্ডিকেট) কোনো বহিঃশক্তি নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। সম্ভবত সে কারণেই সিন্ডিকেট গঠনকে অনেকে প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থার পরিপন্থি গণ্য করে। অস্থিতিশীল বাজারে, বিশেষত বাজারদাম বৃদ্ধিকালে, কোন কোন বিধিসংস্থার অতিউৎসাহের ফলে, ‘সিন্ডিকেট’-কে দানবরূপে দেখানোর মাত্রা বৃদ্ধি পায়। দুঃখজনক যে, এই হুজুগের সাথে সায় দেয় আমাদের দেশের কিছুসংখ্যক প্রচারমাধ্যম এবং (বুদ্ধি-বিক্রয়কারী) অনেক ব্যক্তি ও সংস্থা, যারা সিন্ডিকেট-এর দ্বৈত চরিত্র ধর্তব্যে আনতে ভুলে যায়।
বুঝে হোক, বা না বুঝে হোক, অনেকেই তাই গোষ্ঠী বা একচেটিয়া সিন্ডিকেট-স্বার্থের প্রসার প্রতিহত করার নামে নির্বিচারে ‘প্রতিযোগিতা আইন’ প্রয়োগের ‘ডাণ্ডাবাজি’ সংস্করণের পক্ষ নেয়! ‘দানবরূপী’ সিন্ডিকেটের ধারণাটি প্রায়শই সর্বগ্রাসী এবং বারংবার এজাতীয় ধ্যানধারণা খণ্ডন করা হলেও এর অপ্রতিরোধ্য পুনর্জাগরণ অনেক ক্ষেত্রে সর্বনাশার ইঙ্গিত দেয়। একদিকে বিধিসংস্থাগুলোকে ‘সিন্ডিকেট’-এর উপর দোষ চাপিয়ে নিজেদের দায় এড়াতে সচেষ্ট হতে দেখা যায়। অপরদিকে, স্থানীয় ‘সিন্ডিকেট’দের বাধা হিসেবে গণ্য করে, সেই বাজারে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে, বাইরের স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সিন্ডিকেটবিরোধী উগ্র মনোভাবে ইন্ধন জোগায়।
উপরোক্ত ব্যাখ্যায়, একটি দেশের রাজনৈতিক দল বা সরকারও একটি সিন্ডিকেট, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে জোটবেঁধে সমাজ ও অর্থনীতির বিবিধ অঙ্গনে, প্রণীত বা চাপিয়ে দেয়া আইনের আশ্রয়ে, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই অন্য পাঁচটা সিন্ডিকেটের মতো একটি দেশের সরকার সুশাসন ও প্রজ্ঞা-বলে জনগণের যেমন মঙ্গল আনতে পারে, একইভাবে, অপকর্মের দ্বারা অথবা প্রজ্ঞার অভাবে তারা জনজীবনকে অতিষ্ঠ করতে পারে। এমনকি স্বাধীন সত্ত্বা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্থানীয় একটি (সিন্ডিকেটরূপী) সরকার বিদেশি শক্তির সম্প্রসারণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে সক্ষম।
সাধারণ বৈশিষ্ট্যের বাইরে সিন্ডিকেট গঠন ও বিন্যাসের অতিরিক্ত তিনটি দিক উল্লেখ করব, যা উভয় ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজনীতির অঙ্গনে সিন্ডিকেট গঠন প্রক্রিয়া বোঝার জন্য প্রাসঙ্গিক। প্রথমত, সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনে সিন্ডিকেটসম সংগঠন গড়ে উঠলে তাদেরকে সমন্বয় করার জন্য একক কোনো সংস্থা বা ব্যক্তির উদ্ভব ঘটা স্বাভাবিক, যা বৃহত্তর সিন্ডিকেটের জন্ম দেয়। দ্বিতীয়ত, সুষ্ঠুভাবে কার্যপরিচালনার জন্য একটি প্রতিষ্ঠিত সিন্ডিকেট, খাতভিত্তিক দায়িত্ব বণ্টনের উদ্দেশ্যে, অনেকগুলো অধীনস্ত সিন্ডিকেটের জন্ম দিতে পারে। রাজ্য-কার্যপরিচালনার ইতিহাসে এই দুই ধারারই দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। স্থানীয় সামন্তরা একত্র হয়ে শশাঙ্ককে রাজা বানিয়ে নেয়ার কাহিনি যেমন রয়েছে, তেমনি দূরবর্তী মসনদ থেকে সুবেদার-নিয়োগের প্রথা বারংবার দেখা গেছে। তৃতীয় লক্ষণীয় দিক হলো, সিন্ডিকেটের সাথে তাদের কর্মক্ষেত্রে দায়িত্বরত বিধি সংস্থার মধ্যকার সম্পর্ক সবসময় একমুখী নয়। কোনো কোনো খাতের ‘সিন্ডিকেট’ এতই ক্ষমতাশালী হয়ে উঠে যে তারাই বিধি সংস্থার কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে। এক্ষেত্রে কেউ কেউ বলতে পারেন যে নির্দিষ্ট কোনো খাতে উন্নতি আনতে চাইলে সেখানকার সুবুদ্ধি-সম্পন্ন ব্যবসায়ী/উদ্যোক্তাদের স্বপ্রণোদিত আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য সেজাতীয় প্রভাব প্রয়োজন।
বাজারব্যবস্থার ঊর্ধে থেকে সরকারী প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, আইন-প্রয়োগকারী সংস্থা এবং রাজনীতিবিদরা যে নৈর্ব্যক্তিক ভূমিকায় রাখবেন, এ ব্যাপারে শঙ্কা থাকার কারণেই এজাতীয় উল্টোভাবনা জাগে। যে উদ্দেশ্যেই হোক না কেন, রাজনীতির মাধ্যম ব্যতিরেকে বিধিসংস্থার ওপর সিন্ডিকেটের আধিপত্য নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই, সমাজ ও অর্থনীতির স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য উপযোগী ও আবশ্যিক জোটসমূহকে (বা সিন্ডিকেটকে) ধ্বংস করতে সচেষ্ট অশুভ সিন্ডিকেট থেকে মুক্তি পেতে হলে রাজনীতির অঙ্গনে পরিবর্তন জরুরি। নিবন্ধের বাকি অংশে নিত্যপণ্যের বাজারে ‘সিন্ডিকেট’ নামক সংগঠনের বিবিধ দিক আলোচনায় এনে উপযোগীমূলক (এবং স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠা) সিন্ডিকেটের সাথে (অসৎ উদ্দেশ্যে গঠিত) নিপীড়নমূলক সিন্ডিকেটের পার্থক্য টানার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেব।
নিত্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেট: বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্য প্রথমে ছোট-বড় পাইকারদের মাধ্যমে আড়তদারদের কাছে যায়। পরবর্তীতে, ভোক্তা বাজারের পাইকারদের মাধ্যমে সেসব পণ্য খুচরা বাজার হয়ে ভোক্তাদের হাতে আসে। বাজারচক্রের এই পণ্যপ্রবাহে আমরা লম্বালম্বি উল্টোমুখো দুটো পিরামিডের চিত্র পাই, যেখানে বহু উৎপাদক ও বহু সংখ্যক ভোক্তাদের মাঝে স্বল্পসংখ্যক আড়তদার ও পাইকারদের ক্ষীণ সমাবেশ দেখা যায়। এ ছাড়াও ভোগ্যপণ্য বিপণনের পূর্বে প্রক্রিয়াকরণের প্রয়োজন থাকতে পারে (যেমন, ধান ভাঙানো বা আলুর হিমায়ন)। পণ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণন প্রক্রিয়ায় পণ্যের স্থানান্তর ঘটে, যার বিভিন্ন ধাপে পরিবহণ জড়িত। পণ্যপ্রবাহের সুনির্দিষ্ট কয়েকটি স্তরে স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তি-ব্যবসায়ী বা সংস্থার ভূমিকা আবশ্যিক।
আরো লক্ষণীয় যে প্রক্রিয়াকরণে ও পরিবহনে অধিক পরিমাণ লেনদেন করলে এককপ্রতি খরচ কম পড়ে। এসব কারণে, নির্দিষ্ট স্থানীয় উৎপন্নের বাজারে, স্বাভাবিকভাবে স্বল্পসংখ্যক ব্যবসায়ীর হাতে বাজার ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হবার সম্ভাবনা থাকে। তবে স্থানীয় পণ্যের ক্ষেত্রে সারাদেশব্যাপী এধরণের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীজোট ছড়িয়ে থাকার ফলে ভোক্তাবাজারে প্রবেশের পূর্বে, পরিবহন খাত ব্যতিরেকে, তাদের দ্বারা সিন্ডিকেট গঠনের সম্ভাবনা কম। অবশ্য স্থানীয় পর্যায়ে পাইকার বা মাস্তান/চাদাবাজ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় উৎপাদকের প্রাপ্তি কম হয়।
নাগরিক ভাবনা অধিকাংশ ক্ষেত্রে খুচরা বাজারকে নিয়ে, যেখানে দাম নিয়ন্ত্রণের কারসাজি থাকতে পারে বলে অনেকেরই ধারণা। সাধারণত সনাতনী প্রথায় ভোগ্যপণ্যের খুচরা বাজারে একজন বিক্রেতা স্বনিয়োজিত এবং দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ সীমিত হওয়ায় সংসারের ভরণপোষণ মেটাতে তারা মার্জিনের মাত্রা অধিক রাখে। এটা অবশ্য সিন্ডিকেটের উপস্থিতি প্রমাণ করে না। বরং সম্মিলিতভাবে ন্যূনতম দাম ধার্য – জোটগঠনের বা নেপথ্য নিয়ন্ত্রণের ইঙ্গিত দেয়। খোঁজ নিলে জানা যাবে যে একটি বাজার বা একটি এলাকার কয়েকটি খুচরা বাজারে কোনো একটি পণ্য (যেমন, মুরগি বা ডিম) ধারে-কাছে অবস্থিত একটি আড়ত থেকে সরবরাহ করা হয়।
এসব এলাকাভিত্তিক আড়তদারদের পেছনে অনুমেয় যে বড় ব্যবসায়ী/আড়তদার রয়েছে। এটা অবাক হওয়ার নয় যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে, এলাকাভিত্তিক একচেটিয়া ব্যবসায়ীর উদ্ভব ঘটতে পারে, যে বা যারা, ক্রয়ক্ষমতা বিশেষে ভিন্নভিন্ন বাজারে ভিন্নভিন্ন দাম ধার্য করতে পারে। কিন্তু যারা দীর্ঘকালীন ব্যবসায়ী, তারা কি বাজারের (ক্রেতাদের) ক্রয়ক্ষমতা উপেক্ষা করে এবং দাম ওঠানামার সাধারণ রীতি অগ্রাহ্য করে অতিমাত্রায় মজুত বা অতিরিক্ত দাম ধার্য করতে চাইবে? একাজটি তাদের দ্বারাই সম্ভব যারা স্বল্পমেয়াদে পটে অবতীর্ন হন এবং অতিদ্রুত অর্থ আত্মসাৎ করে বেরুতে চায়, যেমনটি স্বল্পমেয়াদি শেয়ার কেনাবেচার বাজারের খেলুড়েরা করে। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের মাঝে এই আচরণ দেখা গেলে বলতে হয়, তারা ব্যবসা পরিবর্তন বা দেশান্তরে আগ্রহী। অন্যথায়, বাজারের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের ব্যাখ্যা দিতে তৃতীয় কোনো ব্যবসাবহির্ভূত শক্তির উপস্থিতি ও বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।
এই তৃতীয় শক্তি দেখা যায় আমদানির ক্ষেত্রে, যেখানে সিন্ডিকেট গঠনে সরকারের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে – আমদানি লাইসেন্স দেয়া অথবা বৈদেশিক মুদ্রা পেতে সহায়তার মাধ্যমে। দেশে পণ্য আমদানির পর সেই সিন্ডিকেটকে অভ্যন্তরীণ পরিবহন ও বিপণন ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে হয়। বিভিন্ন স্তরে মজুতের পরিমাণ নির্ধারণ সাধারণত প্রত্যাশিত বাজার দামের ওপর নির্ভরশীল। তবে সিন্ডিকেট কর্তৃক আমদানিদামের ঊর্ধ্বে বাজারদাম নির্ধারণ কেবল শীর্ষে (আমদানিকালে) অবস্থিত স্বল্পসংখ্যক ব্যবসায়ীদের পক্ষে সম্ভব। বহুসংখ্যক আমদানিকারক থাকলেও অধিক আমদানিতে পরিবহন খরচে সাশ্রয়ের ফলে সিন্ডিকেট বা একচেটিয়া বাজার উদ্ভবের সম্ভাবনা রয়েই যায়।
১৯৯০-এর দশকে বেসরকারিভাবে গম আমদানিকালে যে গ্রেইন মার্চেন্ট নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক বাজার কাঠামো ছিল, তার কাঠামোগত পরিবর্তন না হলেও এখনকার আমদানি লাইসেন্স-প্রাপ্ত ব্যবসায়ীগোষ্ঠী বাইরের গ্রুপগুলোর সাথে অধিকতর সম্পৃক্ত। লক্ষণীয় যে আঞ্চলিক পর্যায়ে সম্পদশালী ব্যবসাগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছে যারা নিজ দেশের সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পায় এবং পার্শ্ববর্তী ছোটছোট দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে নিজেদের মাঝে অন্তর্ভুক্ত করতে সচেষ্ট। বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না যেয়ে দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ্য যে, মিয়ানমার থেকে ডাল বা অন্য শস্যবীজ সংগ্রহ করে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা অন্য দেশে বিক্রয় করত। ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশকে পার্শ্ববর্তী দেশের বাণিজ্যসংস্থার ওপর নির্ভর করতে হয়, যে আমদানি সিন্ডিকেটে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ীরাও সক্রিয়ভাবে জড়িত। এই সমগ্র প্রক্রিয়াকে আমরা ঠগবাজি সিন্ডিকেট আখ্যা দিব, না কি বিশেষ বাজার ও পরিবহণ ব্যবস্থার স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে গণ্য করব, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। হয়তো দুটোই সত্য!
উপসংহার: পরিশেষে বলব, বাংলাদেশ সমাজে সিন্ডিকেটকে একটি অদৃশ্য অশুভশক্তি হিসেবে দেখানো হয়। আজকাল যেমন অজানা ভাইরাসকে রোগবিদ্যায় করোনা আখ্যা দেয়ার প্রবণতা রয়েছে, তেমনি বাজার ব্যবস্থায় অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ফল দেখলেই তার জন্য অদৃশ্য সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হয়! অথচ সমাজ ও বাজারব্যবস্থা সংগঠিত হতে ‘সিন্ডিকেট’ বা ‘সিন্ডিকেটধর্মী’ সংগঠনের প্রয়োজন। বিশেষত, বাজারের সকল ক্রীড়নক যেন বিধিসম্মত ভাবে কার্যপরিচালনা করে, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্দিষ্ট বিধিসংস্থার এবং সেসব বাজারে ব্যবসায়ী জোট থাকলে তারা সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারে। অবশ্য সেটা নিশ্চিত করার মুখ্য দায়িত্ব ওই সকল বিধিসংস্থার। তাদের ব্যর্থতার ফলে ব্যবসায়ী জোট অসাধু কর্মকাণ্ড চালাতে পারে। এই ব্যর্থতা ঢাকবার জন্য অসাধু ব্যক্তি-ব্যবসায়ী বা সংস্থাকে চিহ্নিত করে উপযুক্ত (শাস্তিমূলক) পদক্ষেপ না নিয়ে, ‘সিন্ডিকেট’ এর ধুয়ো তুলা আজ নিত্যকার ঘটনা। এই একপেশে অবস্থানের ফলে, যেসকল অঙ্গনে ভালো ‘সিন্ডিকেট’ রয়েছে এবং যারা (রাষ্ট্রীয় বিধি লঙ্ঘন না করে) বিদেশি শক্তিকে রুখে দেশীয় সত্তার বিকাশ সাধন করার সম্ভাবনা রাখে, সেসব শুভশক্তির অস্তিত্ব আজ বিপন্ন।
দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কর্তৃপক্ষ, ভোক্তা-অধিকার দপ্তরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা, সংবাদকর্মী এবং আমার মতো বুদ্ধি-বিক্রেতাদের প্রতি আহবান জানাব, তারা যেন সিন্ডিকেট নামক বায়বীয় জুজুর ভয় দেখিয়ে ব্যবসা ও সমাজ অঙ্গনের স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠা এবং বাজার-ব্যবস্থা সচল রাখার জন্য আবশ্যকীয় জোট/ সিন্ডিকেট ধ্বংস করতে মদদ না জোগান। অবশ্যই বাজারে ও সমাজ-রাজনীতিতে দুষ্টচক্র রয়েছে, যারা নাগরিকের কষ্টার্জিত আয় ও সঞ্চয় নিংড়ে নিতে সদা-উন্মুখ। বাজারের সহজাত সংস্থার ধ্বংসযজ্ঞে না নেমে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে, অর্থ-বাজারে এবং রাজনীতির অঙ্গনের সেইসব দুষ্টচক্রকে চিহ্নিত করে তাদের অপকর্ম দমনের উদ্যোগ নেয়া জরুরি।
(নিবন্ধটিতে প্রকাশিত অভিমত ও ব্যাখ্যা লেখকের একান্তই নিজস্ব, যার সাথে ইআরজি-এর অন্যান্য সদস্যদের সহমত নাও থাকতে পারে)
সাজ্জাদ জহির: ইকনোমিক রিসার্চ গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক
Source: https://www.kalbela.com/opinion/sub-editorial/99632
746