ড. সাজ্জাদ জহির |
বণিক বার্তা |
নভেম্বর ১০, ২০২২ |
ডিসিনির্ভর (দ্বৈত নাগরিকত্ব) ব্যবস্থার ভালো-মন্দ দিক রয়েছে। সাধারণত দক্ষিণ ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা উত্তর গোলার্ধের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরির ক্ষেত্রে ডিসিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তবে তাদের অংশগ্রহণ (যৌক্তিক হলেও) দক্ষিণে প্রতিষ্ঠান তৈরিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং সম্পদের বহিঃপ্রবাহকে উৎসাহিত করে । সংকটকালে এ প্রভাব অধিকমাত্রায় অনুভূত হয় এবং সে সময়ে দুর্দশার মাত্রা ততোধিক। একটি দেশ থেকে আরেকটি দেশে অভিগমনের সঙ্গে অন্তর্নিহিতভাবে একটি দেশের অভ্যন্তরে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় (গ্রাম থেকে শহর) অভিগমনের কোনো তফাত নেই। নগরকেন্দ্রে অভিবাসিত হওয়া মানুষজন গ্রামে (কিংবা ছোট শহরের) উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি বিক্রি করে দেয় এবং নিজেদের সন্তানদের লালন-পালনের জন্য শহরে অর্থটা নিয়ে আসে। একইভাবে গ্রামের সচ্ছল পরিবারের অনেকেই সন্তানদের শিক্ষার জন্য শহর এলাকায় পাঠায়, যাদের অনেকেই আর গ্রামে ফেরে না। অবশ্য লোভনীয় বিনিয়োগ, যেমন ঠিকাদারি ব্যবসা, মাছ চাষ, গরুর খামার, রিসোর্ট প্রভৃতির জন্য এদের অনেকে শিকড়ে ফিরে আসে। তারা সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে অর্থ ব্যয় করে এবং জনহিতকার কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন করে। সীমান্ত পেরিয়ে দুদেশের মধ্যে যখন এ ধরনের কর্মকাণ্ড ঘটে, তখন তার বাড়তি প্রভাব থাকে, বিশেষ করে আর্থিক বাজারের ক্ষেত্রে। আন্তঃদেশীয় আর্থিক ও মানবসম্পদ প্রবাহ (চলাচলে) উভয় উৎস দেশ এবং গন্তব্য দেশে বিভিন্ন ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার মুখোমুখি হয় এবং তুলনামূলকভাবে অধিক শক্তিশালী দেশটি নিয়মনীতিগুলো প্রভাবিত করতে পারে। স্বভাবতই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ক্ষমতাশালী দেশের স্বার্থ আন্তঃদেশীয় অর্থ বা সম্পদপ্রবাহের দিক এবং পরিমাণ নির্ধারণ করে ।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে টাকা বা ডলারের দামের ওঠানামার সনাতনী বিশ্লেষণে আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে ডলার (বৈদেশিক মুদ্রার) চাহিদা এবং রফতানি আয় ও এনআরবিদের পাঠানো রেমিট্যান্সের সঙ্গে ডলারের জোগানকে সম্পর্কিত করি। নিবন্ধিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের চাহিদা বাদ দিয়ে খুব সংকীর্ণ পরিসরে দেখলে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদার অন্যান্য কারণের মাঝে রয়েছে পর্যটন, বিদেশে চিকিৎসা, বিদেশী প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ইত্যাদি। এছাড়া ঋণ নিলে বা বৈদেশিক বিনিয়োগ এলে ডলারের জোগান যেমন বাড়ে, ঋণ পরিশোধ বা বিদেশী বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত মুনাফা বাইরে প্রেরণকালে ডলারের চাহিদা বাড়ে। এসবের বাইরে আইনি ও বেআইনি পথে অর্থপ্রবাহের দুটো উল্লেখযোগ্য কারণ হলো, ব্যাংক সুদে আকৃষ্ট হয়ে অর্থপ্রবাহ এবং সম্পদ ক্রয় বা বিক্রয় করে অর্থের দেশান্তর। প্রতিটি চাহিদা বা জোগানের সঙ্গে আমরা নির্দিষ্ট ক্রীড়ক চিহ্নিত করি। যেমন আমদানিকারক, রফতানিকারক বা বিদেশে কর্মরত ব্যক্তি। আমি প্রস্তাব রাখছি, ডিসি নামক ক্রীড়ককে অন্তর্ভুক্ত করলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা (ডলার) বাজার বিশ্লেষণ অধিকতর উপযোগী হবে।
সবাই কমবেশি স্বীকার করেন যে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ আমদানি ব্যয় অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে (২০২২-এর জুনে) আকস্মিক আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণ স্পষ্ট নয়। আমদানিকালে অধিক মূল্যায়নের (ওভার ইনভয়েসিংয়ের) মাধ্যমে অর্থ পাচারের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছিল বলে অনেকে দাবি করেন। তবে এটাও সম্ভব যে ঘাটতি ও মূল্যস্ফীতির শঙ্কায় ইনভেন্টরি গড়ে তোলার জন্য অধিক আমদানি করা হয়ে থাকতে পারে। দুটোর পরিণতি ভিন্ন প্রকৃতির। আমদানি, রফতানি ও রেমিট্যান্সের গতিপ্রকৃতি সামষ্টিকভাবে অনুধাবনযোগ্য। সে তুলনায় অন্যান্য ব্যক্তি খাতের নিট (ডলার) চাহিদা অনেক বেশি অনিশ্চিত। তবে ডিসি নামক ক্রীড়ক অন্তর্ভুক্ত করলে তা অনেকাংশে অনুধাবন ও অনিশ্চয়তার মাত্রা হ্রাস সম্ভব এবং কার্যকর নীতির ভিন্ন একটি দিকের প্রতি নজর দেয়া সম্ভব।
শুরুতে ডিসি সম্প্রদায়ের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য স্মরণ করা প্রয়োজন। প্রথমত, তারা সহজেই এক দেশ থেকে অর্থ আনা-নেয়া করতে পারে। আইনিভাবে অধিক সুদের আশায় যেমন তারা দক্ষিণের ব্যাংকে বিনিয়োগ করতে পারে, তেমনি মার্কিন/উত্তরের ব্যাংকে সুদের হার বাড়লে বা মুদ্রার বিনিময় হার অবমূল্যায়নের শঙ্কা জাগলে সহজেই আইনি বা বেআইনি পথে তা বিদেশী মুদ্রায় নিয়ে যেতে পারে। একটু খোঁজ নিলেই জানবেন যে তাদের অর্থ পাচার বা জঙ্গি অর্থায়নের অপবাদ দিয়ে কেউ অপদস্থ করে না। দ্বিতীয়ত, তাদের চারণভূমি ন্যূনতম দুদেশে বিস্তৃত হওয়ার ফলে এবং সে দেশগুলোর সরকারের স্বার্থ সবসময় পরিপূরক না হওয়ায় ডিসিদের পক্ষে এক দেশে অপরাধ করে অন্য দেশে আইনানুগভাবে বসবাস করা সম্ভব। তৃতীয়ত, এদের মাঝে নিজ সঞ্চয়ে গড়া অথবা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি বিক্রয় করে উত্তরের দেশে অর্থ নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা তীব্র থাকাটাই স্বাভাবিক। সর্বোপরি, সামাজিক সংযুক্তিতে ডিসি সম্প্রদায় অন্যদের থেকে তুলনামূলকভাবে এগিয়ে আছে। একদিকে দক্ষিণের শাসক মহলের ঝরে পড়া উত্তরে অভিবাসিত অংশ তাদের প্রতিবেশী, অন্যদিকে নিজেদের ও ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে আগ্রহী বহির্মুখী পরিবার ডিসিদের সেবা দিতে উন্মুুখ থাকে। কিছু কিছু সেবাধর্মী খাতে, বিশেষত ব্যাংকিং এবং সরকারি সেবাদানে এ উন্মুখতা অতিমাত্রায় দৃশ্যমান।
উল্লিখিত উপাদানগুলো সমন্বিতভাবে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারের কর্মকাণ্ডে ও বিনিময় হারের অস্থিরতায় প্রভাব ফেলে। বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গিয়ে প্রস্তাবের পক্ষে কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করব।
স্বাভাবিক সময়ে যখন ব্যাংকের আমানতের হার এবং বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকে এবং যখন কভিডজনিত মন্দা-পরবর্তী সময়ে সম্পত্তির মূল্যবৃদ্ধি আশা করা হয়, তখন টাকার (ডলারের) বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকবে বলে আশা করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী অনিশ্চয়তা, রিজার্ভ হ্রাস এবং দীর্ঘ প্রতীক্ষিত অবমূল্যায়নের আংশিক বাস্তবায়নসহ ধারাবাহিক অভিঘাতগুলো সে প্রত্যাশাকে ব্যাহত করেছে। কিছুদিন আগেও ডিসিরা সঞ্চয়পত্রে অধিক আমানতের হার থেকে উপকৃত হয়েছিল। বাংলাদেশের ব্যাংক আমানতের হার কমে যাওয়া, যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকের সুদহার বৃদ্ধি এবং টাকার অবমূল্যায়নের আশঙ্কায় অনেকেই সম্ভবত তাদের আর্থিক সম্পদের পাশাপাশি স্থাবর সম্পত্তিগুলোকে মার্কিন ডলারে রূপান্তরিত করতে হিড়িক তোলে। এ-সম্পর্কিত তথ্য সংগৃহীত হয় না বিধায় পক্ষে-বিপক্ষে পরিসংখ্যান দেয়া সম্ভব নয়। তবে আশপাশে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের কর্মকাণ্ড লক্ষ করলেই প্রস্তাবের পক্ষে দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। এ বাড়তি চাপ বিনিময় হারকে অধিকতর অস্থিতিশীল করেছে, যা সম্ভবত, সম্পত্তি কেনাবেচার বাজারে দীর্ঘসূত্রতা থাকার কারণে কিছুটা প্রশমিত রয়েছে।
ডলারের চাহিদার ঊর্ধ্বমুখী অস্থিরতার পেছনে আরো একটি কারণ শিক্ষাজনিত চাহিদা। অন্যান্য বছরের মতো জুলাই-আগস্ট মৌসুমে বিদেশে শিক্ষার উদ্দেশ্যে ডলারের চাহিদা বেড়েছিল। তবে চলতি বছর ভিসা অনুমোদনে (বিদেশী মিশন) বিলম্বিত সিদ্ধান্ত নেয়ায় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের শিক্ষা তহবিল থেকে ডলারপ্রাপ্তির অনিশ্চয়তার কারণে অনেক অভিভাবককে তাদের সন্তানদের শিক্ষা বাবদ আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতে ডলার জোগাড়ে খোলাবাজারের (কার্ব মার্কেট) ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল।
ডিসি ও বৈদেশিক ঋণ
দক্ষিণের দেশের নীতিনির্ধারণে ডিসিদের অধিক প্রভাব থাকলে এটা অবাক হওয়ার নয় যে সে দেশে বিদেশ থেকে ঋণ নেয়ার প্রবণতা থাকবে, ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ খেলাপি করে বিদেশে পুঁজি পাচার ঘটবে এবং এসবই সে দেশের প্রতিষ্ঠানের অবক্ষয় ও বিলুপ্তির সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। সবচেয়ে বড় কথা, সমৃদ্ধি ও সংকটকালে ডিসিরা দক্ষিণের দেশে একই মাত্রায় থাকে না। সমৃদ্ধিকালে ভিড় জমালে তাদের অধিকাংশকে সংকটকালে উত্তরমুখী হতে দেখা যায়, যা দক্ষিণের অর্থনীতিকে (এবং সমাজকে) অধিক নাজুক ও দুর্বল করে তোলে। আমি শুধু অর্থনীতির সীমিত পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকব। প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত ও শক্তিশালী কোনো দেশের প্রতি (কিংবা শক্তিশালী কোনো একটি দেশের মিত্র দেশের প্রতি), যেখানে স্থায়ীভাবে অভিবাসী হয়েছে, ডিসিদের আইনি আনুগত্য থাকাটাই স্বাভাবিক। একই সঙ্গে নতুন নাগরিকত্বের দেশগুলোয় তারা নিজের বংশধরদের ভবিষ্যৎ দেখে। তাই ডিসিদের সঞ্চয় ও ভবিষ্যৎ সেই উত্তরের দেশের মাটিতে এবং তা বাস্তবায়নে সহায়ক নীতি প্রণয়নে তারা উদ্যোগী হবে। নিম্নোক্ত কয়েকটি কারণে ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক ঋণ তাদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হতে পারে।
প্রথমত, ঋণের দায় তাদের নিজেদের এবং বংশধরদের ওপর পড়ে না।
দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক ঋণ বৈদেশিক মুদ্রার সম্পদ বাড়ায়, যা তাদের সম্পদ ট্রান্সফার সহজ করে দেয়।
তৃতীয়ত, এ ধরনের ঋণে অর্থায়িত প্রকল্পগুলো কোনো রেকর্ড না রাখা ছাড়াই সম্পদ হস্তান্তরের সুযোগ দেয়। একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণবাহিত বৈদেশিক মুদ্রা উন্নত দেশে বসবাসকারী পরিবারের সদস্যদের কাছে ঘন ঘন ভ্রমণের সুযোগ করে দেয়।
উপসংহার
এ নিবন্ধে যে সমাজচিত্র এঁকেছি, তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমার নানা লেখা থেকে নেয়া। নিজের সঙ্গে এবং স্বগোত্রীয়দের সঙ্গে বোঝাপড়াটাই ছিল এর মুখ্য উদ্দেশ্য। মনে হয়েছে যে স্বত্বার পুনর্গঠন বা পুনর্নির্মাণই অর্থনীতি ও সমাজের ব্যস্থাপনার দিকে যাত্রার প্রথম ধাপ। এ স্বত্বার বিবিধ রূপ অনুধাবন করা জরুরি এবং ডিসি সম্প্রদায়ের সঙ্গে স্থানীয় বা দেশী সমাজের টেকসই ও স্বদেশের জন্য উপযোগী সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কিছু পরামর্শ রইল।
প্রথমত, দ্বৈত নাগরিকের বিভিন্ন শ্রেণীর মূল্যায়নের আলোকে নাগরিকত্ব আইনটি পর্যালোচনা ও হালনাগাদ করা সর্বাধিক গুরুত্ব রাখে। কাজটি সম্পাদনকালে স্বদেশ এবং সেখানে বসবাসরত মানুষের সুরক্ষা ও সমৃদ্ধিকল্পে নীতি প্রণয়নকে সহজ করার বিষয়টি গুনতিতে আনা প্রয়োজন। অভিবাসনের ভিন্ন একটি রূপ এ নিবন্ধে আলোচনায় আসেনি, যা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেকেন্ড হোম অর্থাৎ দ্বিতীয় আবাস, যা বিশেষ ভিসা প্রদানের মাধ্যমে কার্যকর করা হয়, বাংলাদেশের অভিবাসন খাত খাটো করে দেখার নয়। এদেরই একটি বিশেষ প্রকাশ আমরা দেখতে পাই পার্শ্ববর্তী দেশের ধর্মভিত্তিক অথবা রাজনৈতিক বিবেচনায় ভিসা প্রদানে। রাজনৈতিক তাত্পর্যের বিচারে এ দীর্ঘকালীন ভিসাভিত্তিক গোষ্ঠীকে দ্বৈত নাগরিক গণ্য করে নাগরিকত্ব আইন ও নীতি প্রণয়নে তাদের ধর্তব্যে আনা প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, অন্যান্য দেশের সঙ্গে বিশেষত উত্তর ও পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে দ্বৈত করনীতি রয়েছে তা পুনরায় পর্যালোচনা করে সেখানে ডিসি সম্প্রদায়কে সুস্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। প্রায়োগিক সুবিধার জন্য কর নিরূপণে আবাস বা রেসিডেন্সির সংজ্ঞা সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন যা পক্ষপাতহীনভাবে কার্যকর করা জরুরি।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশের নাগরিকদের বিদেশী মুদ্রা ব্যবহারের বার্ষিক কোটা রয়েছে। দ্বৈত নাগরিকরূপী এফসিবিওদের ক্ষেত্রে সে ধরনের বার্ষিক কোটা উপভোগের সুযোগসংক্রান্ত কোনো লিখিত নীতি আমার চোখে পড়েনি। এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নীতির প্রয়োজন। সেই নীতি যদি ডিসিদের দেশ থেকে বহির্গমনের সময় কোটার সুবিধা না দেয়, আগমনকালে তাদের ঘোষিত পরিমাণের অতিরিক্ত কোনো নগদ বৈদেশিক মুদ্রা বহির্গমনকালে নিতে দেয়া উচিত নয়। উত্তরাধিকার হিসেবে সম্পত্তি বিক্রির অর্থ দেশান্তরের ক্ষেত্রে অনেকেই ব্যতিক্রম আশা করেন। এ প্রসঙ্গে দেশের উন্নয়ন ও ব্যালান্স অব পেমেন্টের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব বিবেচনা করে আইনানুগভাবে সীমিত প্রবাহে এ সুযোগ দেয়ার প্রস্তাব অতীতে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে আমি করেছিলাম (বিদেশে অর্থ প্রেরণ ও স্বদেশে বিনিয়োগকে আইনি কাঠামোয় সংযুক্ত করা প্রয়োজন, সাক্ষাত্কার, বণিক বার্তা, ২ মে, ২০১৯)।
চতুর্থত, রাষ্ট্রগঠন ও একটি দেশের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য টেকসই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অনেকেই আজ দেশজ প্রতিষ্ঠানের অবক্ষয়ের বাস্তবতা স্বীকার করেন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এক্ষেত্রে যেমন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, তেমনি, নিজ নিজ ক্ষেত্রে এ দেশের শিক্ষিত সমাজের ব্যর্থতা অনস্বীকার্য। এ অবস্থায় রুখে দাঁড়ানোর জন্য বিজাতীয় ভাবনা ও প্রত্যক্ষ অনুপ্রবেশ বর্জন জরুরি। তাই ডিসি সম্প্রদায়ের মধ্যকার সুযোগসন্ধানী ও স্বল্পকালীন ভাগ্যান্বেষীদের পরিহার করে প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠনের পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। তবে এ বাছাই প্রক্রিয়া কার্যকর করতে হলে সুদৃঢ় রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রয়োজন। ডিসি সম্প্রদায়ের শ্রেণীবিভাজন সম্পন্ন হলে প্রাথমিক ধাপে খাত বিশেষে বাছাইবিধি প্রণয়ন সম্ভব।
পঞ্চমত, যেসব প্রকল্পে এরই মধ্যে বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে সেগুলো শেষ করার জন্য বৈদেশিক তহবিলের প্রয়োজন না হলে ঋণ নেয়া এড়ানো বাঞ্ছনীয়। তার পরিবর্তে ব্যয় কমানোর দিকে নজর দেয়া দরকার, বিশেষত সরকারি খাতে এবং জ্বালানি ও খাদ্যনির্ভর পরিষেবাগুলোর ব্যক্তি পর্যায়ের খরচে।
পরিশেষে, আমরা যদি দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদন কার্যক্রম সুরক্ষার কথা বলতে পারি, একই নীতি স্থানীয় শিক্ষাসেবা ও স্থানীয় সংস্কৃতি সুরক্ষার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যা অধিক মনোযোগ দাবি করে। আজ এক অনিয়ন্ত্রিত স্বেচ্ছাচারী বাজারে একদিকে যেমন সেকেন্ড হোমের ব্যবসা চলছে, তেমনি কূটনীতির লেবাসে বৈদেশিক স্বার্থে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যবসা চলছে। দীর্ঘ অবহেলার বাস্তবতায় শিক্ষা খাতে একটি সতর্কিত প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে—একটি সংস্থাকে ক্ষমতায়িত করা, যার সঙ্গে বাইরের সব প্রতিষ্ঠান (ব্যবসাকাজে লিপ্ত কূটনৈতিক মিশনসহ) নিবন্ধিত হবে এবং যে সংস্থা সেবার বাজারকে স্বীকৃতি দিয়ে দেশের স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হবে। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে সার্বভৌমত্ব এবং জনগণের মঙ্গলকে উন্নীত করতে আগ্রহী সব গোষ্ঠীর (দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশীসহ) মধ্যে নতুন সামাজিক চুক্তির আলোচনা এবং গোষ্ঠী শনাক্তকরণের অনুশীলন একত্রে চালু হতে পারে। সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে অধিকতর ক্ষমতাধর দেশী-বিদেশী খেলোয়াড়দের মাঝে স্বদেশীয় কৌশলী রাজনীতিবিদদের জন্য কোনো ভূমিকা থাকবে না!
[এ নিবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব]
ড. সাজ্জাদ জহির: অর্থনীতিবিদ, নির্বাহী পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ
Email: sajjadzohir@gmail.com
Source: https://bonikbarta.net/home/news_description/320385/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B6%E0%A6%B9%E0%A7%80%E0%A6%A6-%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0,-%E0%A6%AE%E0%A6%A7%E0%A7%81%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BF%E0%A6%A8-%E0%A6%93-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%AA%E0%A7%80-%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A6%B2-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6
2226