আ র পাঁচটা দেশের মতো আমাদের মধ্যবিত্তও নিজস্ব মালিকানাধীন বাসস্থানের স্বপ্নদেখে। মধ্যবিত্ত বলছি এ’কারণে যে, গ্রাম্য ভূমি-কেন্দ্রিক শেকড় থেকে বেরিয়ে এসে নগরে নতুন আবাসস্থল গড়ার ইতিহাসের সাথে ‘মধ্যবিত্তে’র আবির্ভাব ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। সীমিত পরিমাণ জমির দেশে ক্রমবর্ধিষ্ণু এবং স্ফীত আয়ের মধ্যবিত্তের চাহিদার কারণে আবাসনের দাম বৃদ্ধি হওয়াটাই স্বাভাবিক। বহুতল-বিশিষ্ট দালান তৈরির মাধ্যমে জোগানে বৃদ্ধি ঘটলেও ঢাকা শহরে আবাসনের দাম দীর্ঘকাল বিরামহীন বেড়েছিল। সেই সুবাদে ব্যাংক-ঋনের পরিমাণ ওসুদের হার বৃদ্ধি, এবং শেয়ার বাজারে লেনদেন ও স্টকের দাম বৃদ্ধি পাবার সুযোগ পেয়েছিল। ২০১১-১২ সালে শেয়ার বাজারের ধ্বস ও শ্লথ অর্থনীতিক কর্মকান্ডের ফলশ্রুতিতে আবাসন-খাতে যে বিরূপ প্রভাব পড়েছিল, তা সকলেরই জানা। উন্নত দেশের মত আমাদের অনেক নীতি-নির্ধারকরা প্রপার্টি-ডেভেলপারদের দূর্দশার কথা স্মরণ করে এ’খাতে সহজ ঋণের সরবরাহ বৃদ্ধি করে সচলতা ফিরিয়ে আনার কথা বলেন। অথচ, উপযুক্ত বিধি-ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে অনেক ডেভেলপারেরা খদ্দেরের অর্থ দালান-তৈরীতে ব্যবহার না করে অন্যত্র নয়-ছয় করেছে। পরিতাপের বিষয় যে,অসম্পাদিত চুক্তিতে আটকে পড়া এপার্টমেন্ট-ক্রেতাদের নিদারুণ যন্ত্রণা নিরসনের কোন উদ্যোগ সরকারী পর্যায়ে আমরা দেখিনি। এমনকি, পার্শ্ববর্তী দেশের ন্যায়, বঞ্চিত ক্রেতাদের মাঝে কোনও নাগরিক উদ্যোগও আমরা দেখিনি। বরং, বঞ্চনার শিকার হয়ে মন্দা বাজারে যখন যথার্থভাড়া পাওয়াও দুষ্কর, আটকে পড়া বিনিয়োগ থেকে কিছু প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে ক্রেতাদের অনেকেই স্ব-উদ্যোগে এবং নিজের বাড়তি খরচে অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে সচেষ্ট। আবাসন বাজারের আড়ালে নির্মান ও গৃহসজ্জা কাজে নিয়োজিত এক বিশাল শ্রমবাজার রয়েছে, যা সামষ্টিক আলোচনায় দৃশ্যতনয়। বিষয়টি অবতারনা করে অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রী, গবেষক এবং নগর-পরিকল্পনাবিদদের আগ্রহ জাগানো এই নিবন্ধের একটি উদ্দেশ্য। আশা করবো যে, এধরনের অনুশীলনে আবাসন বাজারের ভোক্তারা লাভবান হবেন এবং এই খাতের টেকসই উন্নয়নে তা সহায়ক হবে।
অতীতে একটি সময় ছিল যখন আমাদের পূর্বসুরীদের অধিকাংশই কিছু কারিগরি সহায়তা নিয়ে নিজের তত্ত্বাবধায়নে শ্রমিক ব্যবহার করে নিজের জমিতে বাসা তৈরি করতেন। সেসময় রাজমিস্ত্রি’র সর্বাধিক ভূমিকা ছিল, রঙের বিচিত্রতা ছিল না, মোজাইকের ব্যবহার ‘আধুনিক’ গণ্য করায় কিছু সংখ্যক ভিন্ন দক্ষতার শ্রমিক ছিল, তবে যে কাঠমিস্ত্রি আসবাবপত্র বানাতো সেই-ইপলিশের কাজ করতো। আশির দশকে ঢাকার আবাসন খাতে প্রপার্টি ডেভেলপারদের উল্লেখজনক আগমন লক্ষ্য করা যায়, যারা নব্বুই ও তার পরবর্তীকালে এ’বাজারের মুখ্য চালিকাশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। বহুতল-বিশিষ্ট দালানে এপার্টমেন্টের এই বাজারে একজন মালিকানায় আগ্রহী ক্রেতাকে সরাসরি নির্মানে অংশ নিতে হয়নি, এবং সে’কারণে নির্মান-শ্রমিকদের সংস্পর্শে আসতে হয়নি। কেনার আগ্রহ বাজারে প্রচার পেলে, রিয়েল এস্টেট কোম্পানী’র একজন মার্কেটিং অফিসারকে ক্রেতার দ্বারে উপস্থিত হতে দেখা গেছে। নানান লোকেশন দেখে ও একাধিক ডেভেলপারের সাথে কথা বলার পর একজন ক্রেতা চুক্তিপত্রে সই করেছেন, এবং বড় অংকের আগাম অর্থ দিয়ে এপার্টমেন্ট ডেলিভারি হওয়া অবধি কিস্তির টাকা দিয়েছেন। কিছুদিন আগ-পর্যন্ত এই ব্যবস্থায় এপার্টমেন্ট-ক্রেতাকে সাধারণত শ্রমিক বা শ্রম-নিয়োগকারী ঠিকেদারদের সাথে যোগাযোগ করতে হতোনা। প্রয়োজন হলে,বড়জোর ইন্টেরিয়র ডিজাইনারের সাথে বসতে হতো। মাঠপর্যায়ের প্রাথমিক তথ্য থেকে জানা যায় যে, আবাসন শিল্পের স্থবিরতায় শ্রমবাজারে এবং শ্রম-সংগঠনে কিছু মৌলিক পরিবর্তন এসেছে,যার পরিণতিতে ক্রেতা-মালিকদের শ্রমবাজারের সাথে সরাসরি সংযোগ করতে হয়েছে। এ’নিবন্ধে শ্রমব্যবস্থার পরিবর্তনের ধারা উল্লেখ করে সম্ভাবনার দিকগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিব।
আবাসস্থল নির্মান ও বাসপোযোগী করবার জন্য অনেকগুলো ভিন্নধর্মী কার্যক্রমের সমন্বয় করা প্রয়োজন। এসব কাজের কিয়দাংশ পেশাভিত্তিক বা অফিস-কেন্দ্রিক, যেমন, নকশা প্রণয়ন, আইনি কাগজপত্রের অনুমোদন বা ছাড়পত্র সংগ্রহ, অর্থায়ন ব্যবস্থা ও এপার্টমেন্ টবিক্রি। কায়িক শ্রমের জন্য রয়েছে বিভিন্ন শ্রমিকদল। বাজারে নানাজাতের সরঞ্জামাদি আসাতে, এবং বাজারের আকার বৃদ্ধির ফলে ক্ষুদ্রতর কাজ-ভিত্তিক বিশেষায়িত শ্রমদলের আবির্ভাব ঘটেছে।প্ রতিটি দলই আলাদা আলাদা ঠিকেদারের অধীনে কাজ করে। এসব কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, রাজমিস্ত্রী’র (নির্মান) কাজ, স্যানিটারী (প্লাম্বিং), কাঠমিস্ত্রির কাজ (কাঠ বা বোর্ডদিয়ে আসবাবপত্র তৈরি), রং-পলিশের কাজ, টাইলস বা মার্বেল বসানো, গ্রিল বা এলুমিনিয়্যাম-এরকাজ, এবং বিদ্যুত-এর কাজ। এসবের অনেক কাজই বরাবরই ডেভেলপারের সাথে সরাসরি যুক্ত থেকেছে। তবে, অনেকেই পণ্য-সরবরাহকারী সংস্থার সাথে যুক্ত থেকে আবাসন-নির্মানের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে।
কৃষিশ্রম ও তার সাথে ঋন-সহ অন্যান্য বাজারের সম্পৃক্ততা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা অনেক লিখেছেন। সে তুলনায় আবাসন শ্রমিকদের কাহিনী অনেকাংশেই অদৃশ্য রয়ে গেছে, এমনকি সমাজ বিজ্ঞানীদের গবেষণা ও আলোচনার থেকেও। অতি সংক্ষেপে বললে, সার্বক্ষণিক কাজ না থাকলে অথবা জরুরী ভিত্তিতে কাজ শেষ করার তাগিদ থাকলে, শ্রম-সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য অ্যাডভ্যান্সের (আগাম বা ঋণের) মাধ্যমে শ্রমকে বাঁধার চল রয়েছে। সার্বিক সমন্বয়ের কাজটি তাই “ঠিকেদার”-এর জন্ম দেয়, যা আমাদের সমাজের সর্বত্র বিরাজমান—কৃষিশ্রম, বিপণন ব্যবস্থা, কর-আদায় ব্যবস্থায়, এমনকি এনজিও দল গঠন প্রক্রিয়াতেও। উভয় অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের জন্য খাজনা-নির্ভর সমাজ, ঠিকেদারী ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের মধ্যকার সম্পর্ক নতুন গবেষণার খোরাক দিতে পারে। তবে, আমরা আবাসন-শ্রমের সংগঠন ও তার বিবর্তনের মাঝেই এ’নিবন্ধের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবো।
২০১০ সনের আগে অবধি আবাসন খাতের শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণ করতো ডেভেলপাররা এবং(আসবাবপত্র তৈরীর মত) কিছু বিশেষায়িত ফ্যাক্টরী। প্রাক-২০১০ পর্বকে দুটো ভাগে দেখাযায়। প্রথম পর্বে, একটি নির্দিষ্ট দালানের সকল এপার্টমেন্ট কম-বেশী একই ধাঁচে তৈরী হতো—বিভিন্ন ক্রেতা-মালিকের রুচির প্রতি কম অথবা কোনও নজরই দেয়া হতো না। ততদিনে অবশ্য সামর্থ্য ও স্বাদ অনুযায়ী ক্রেতাদের মধ্যকার বিভক্তি অনুসরণ করে ডেভেলপাররাও বাজারের একেকটি অংশ বেছে নেয়। এ’পর্বে, তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করার তাগিদ দেয়া ছাড়া সাধারণত, শ্রমিকদের তদারকিতে ক্লায়েন্টরা সরাসরি জড়িত থাকতেন না। ডেভেলপাররাই বরং সকল শ্রম-নিয়োগকারী ঠিকেদারদের ‘বড় ঠিকেদার’ হিসেবে কাজ করে এসেছে। প্রাথমিক আলোচনা থেকে জানা যায় যে, সেসময় সীমিত সংখ্যক ডেভেলপার থাকায় ও তাদের ব্যবসা ঊর্ধমুখী থাকায়, খন্ডকালীন চুক্তিভিত্তিক কাজহলেও, নির্দিষ্ট একটি শ্রমদলকে একজন ডেভেলপার দীর্ঘকালীন কাজে আবদ্ধ রাখতে পারতো। সেকারণে, শ্রমিক-দলে অধিক স্থিতিশীলতা ছিল, এবং ঠিকেদার-প্রথার মাধ্যমে ডেভেলপারদের সাথে তাদের সরাসরি (লম্বালম্বি) সম্পৃক্ততা থাকতো। শ্রম-ব্যবস্থাপনায় এধরনের মেলবন্ধন থাকায় শ্রমযোগানে নিশ্চয়তা ছিল এবং বিনিয়োগকারী’র (নির্মাতা অথবা ক্রেতা-মালিক) গড়পরতা নির্মান-খরচ কমহতো। অনেকে অবশ্য এ’জাতীয় ব্যবস্থায় শোষণের ঘ্রাণ পাবেন — কৃষিপণ্য উৎপাদন ও বাণিজ্যে যেমন দাদন প্রথার চল রয়েছে (বা ছিল), তেমনি, এক্ষেত্রেও আগাম দিয়ে শ্রমযোগান নিশ্চিতকরার চর্চা লক্ষণীয়।
আবাসন খাতের বিবর্তনে দ্বিতীয় পর্বের সূচনা ঘটে চাহিদায় উল্লেখজনক পরিবর্তন আসার কারনে। বাজারদাম ঊর্ধমুখী থাকাকালীন সময়েই চাহিদার ধরণেও বিচিত্রতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিল, যা স্থানীয় জনগোষ্ঠী’র আয়বৃদ্ধি ও অবাধ আমদানী-নীতি’র ফলে সম্ভব হয়েছিল। একই দালানে বিভিন্ন এপার্টমেন্টে নানা সংস্কৃতির লোক যখন ক্রেতা হিসেবে জড়ো হয়, তাদের সকলের স্বাদ-আহ্লাদ একটি নির্দিষ্ট জাতের পণ্যসামগ্রী দিয়ে মেটানো সম্ভব নয়। সঙ্গতঃকারনে, একই দালানে সমমানের (স্ট্যান্ডার্ড) নির্মান ও’ ইন্টেরিয়র (অভ্যন্তর) সামগ্রী’র চাহিদা হ্রাস পেল। অর্থাৎ ভিন্নমানের বিচিত্রধর্মী চাহিদার প্রকাশ ঘটলো, যার সমন্বয় দুরূহ হয়ে উঠলো। স্থাপত্য-নকশা ও ক্রেতার ছোটখাটো চাহিদা মিটিয়ে স্ট্র্যাকচারাল (কাঠামোগত) ডিজাইন-এর মৌলিক কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাই ‘ইন্টেরিয়র’ কাজের বাজারের প্রসার ঘটে। সেবা’র পৃথকীকরন হলেও শুরুতে ডেভেলপারদের অনেকেই এর সুযোগ নিয়ে গ্রহণযোগ্য মানের ফিটিংস ও ডেকোরেশন না করার একটি বাহানা পেলো, এবং সেইসুবাদে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী সেবা সরবরাহের নামে বাড়তি অর্থ উপার্জনের সুযোগ করে নিল। ডেভেলপারদের এই দ্বৈত ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার প্রক্রিয়ায় বর্গফুট-ভিত্তিক আবাসন-দামের এককেও পরিবর্তন এলো। অনেকক্ষেত্রেই বর্গফুট-প্রতি দাম একই থাকলেও খরচের একটা বড় অংশ ক্রেতাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। সেইসাথে, ক্রেতা-মালিকদের অনেকেই সরাসরি আবাসন-পণ্যের সরবরাহকারী ও শ্রমিক-ঠিকেদারদের সংস্পর্শে আসতে বাধ্য হয়।
উপরে উল্লেখিত দ্বিতীয় পর্বের সমাপ্তি ঘটে ২০১১-১২ সাল নাগাদ, মূলতঃ শেয়ারবাজারে ধ্বস নামার পর। জমি কেনাবেচা ও আবাসন নির্মানে জড়িত ব্যাক্তিদের প্রায় সকলেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। উভয় জমির মূল মালিক এবং এপার্টমেন্ট-ক্রেতাদের কাছ থেকে আম-মোক্তারনামা পাওয়ার ফলে, এবং ব্যাংকগুলো সেসব দলিলকে জামানত হিসেবে গ্রহণ করায়, ডেভেলপারদের অনেকেই ব্যাংক থেকে বিশাল অংকের ঋণ নিয়ে থাকে। প্রাথমিক অনুসন্ধান থেকে জানা যায় যে, সেসব অর্থের উল্লেখজনক অংশ, শিথিল বিধিমালার সুযোগ নিয়ে, তেজী শেয়ার বাজারে ‘খাটানো’ হয়েছিল। আকস্মিক শেয়ার-দাম পতনের ফলে আবাসন চাহিদাতেও মন্দা দেখা দেয়, যার ফলশ্রুতিতে ব্যাংকের দেনা পরিশোধে ঘাটতি পড়ে। সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ আছে অথচ দেনাগ্রস্থ হয়ে নগদের অভাব—তাই, হাতে নেয়া প্রকল্প সমাপ্তির কাজও থমকে দাঁড়ায়। এই বিপর্যয়ে কর্ম-সংস্থান নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় শ্রমিকদের উপর ডেভেলপারদের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই ঢিলে হয়ে যায়, এবং আবাসন খাতের শ্রমবাজারে আবির্ভাব ঘটে ‘মুক্ত কারিগর’ দলের। যেসকল শ্রমিক কর্মদক্ষতার কারনে সামাজিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে পেরেছিল এবং নিয়োগ দাতাদের আস্থাভাজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল,তাদের অনেকে (বিদেশে পাড়ি না জমালে) ‘ঠিকেদার-কাম-শ্রমিক’ হিসাবে বাজারে দেখা দেয়। অন্যান্য সেবা বাজারের মত আবাসন খাতেও ‘মুক্ত শ্রমিক’-এর আগমনের সাথে কর্ম-সম্পাদনের অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পায়, এবং ক্ষুদ্র-পুঁজির ঠিকেদারদের অধিক অর্জনের প্রয়াসে অধিক ঝুঁকিনিতে হয়। সব মিলিয়ে, বিবর্তনের এই তৃতীয় পর্বে, একটি সুনির্দিষ্ট কাজ সম্পাদনের জন্য ভোক্তা পর্যায়ে খরচের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে, কার্য সম্পাদনের চুক্তি-ভঙ্গের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পর্যায়ের বহুমাত্রিক শ্রম-ব্যবস্থাপনায় ভোক্তারা জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হওয়ায় সামষ্টিক সামাজিক ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে।
আবাসনখাতে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং শ্রমচাহিদা ও শ্রম-ব্যবস্থাপনায় নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের প্রভাবের বিষয়গুলো এ’নিবন্ধে আলোচনা করা সম্ভব হয়নি। অতি সংক্ষেপে বললে, নির্মান ও অভ্যন্তরের সাজ-সজ্জ্বায় প্রযুক্তির আগমন ঘটলেও, তার ব্যবহার মূলতঃ বাণিজ্যিক ভবন তৈরিতে সীমাবদ্ধ থেকেছে। তাই, শ্রম-ব্যবহারে সনাতনী প্রথা ও আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার সমান্তরাল ভাবে চলছে। পর্যাপ্ত তথ্য ও বিশ্লেষণ ছাড়া বিবর্তন-ধারায় আবাসনখাতের শ্রমবাজার আগামীতে কোন পথে এগুবে তানিশ্চিত বলা সম্ভব নয়। শিক্ষার অভাব, পারস্পরিক বিশ্বাস-বোধের ঘাটতি এবং উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানিক রূপরেখার অভাবে বর্তমানের ‘মুক্ত শ্রমিকদল’ আদতেই স্থায়িত্ব পাবে কিনা, সেব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। অন্যত্র কর্মসংস্থানের বিস্তৃতিনা ঘটলে, সমাজ-অর্থনীতিতে বৈষম্য থাকলে এবং চাহিদার বিচিত্র সাধ মেটাতে সক্ষম বিশাল জনগোষ্ঠী থাকলে, এই ব্যবস্থা বহুদিন চলতে পারে। বিকল্প হিসেবে, শ্রম নিয়োগের এজেন্সী গুরুত্বপূর্ন ভূমিকায় এসে শ্রম যোগান ও চাহিদার মাঝে মধ্যস্ততা করতে পারে। তবে, এমনকি উন্নত দেশেও সে ব্যবস্থা দেখা যায় না – সেখানে যন্ত্র-নির্ভর স্ব-নিয়োজিত ব্যাক্তি-শ্রমিকের আধিক্য রয়েছে। বাকী থাকে তিনটি পথ — পুনঃসংগঠিত ডেভেলপার গোষ্ঠী, অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সংস্থা, এবং পণ্য-সরবরাহকারী গোষ্ঠী-ভিত্তিক বিশেষায়িত শ্রমিক দল। অদূর ভবিষ্যতে এই তিনটির সমন্বয়ে শ্রমবাজার বিবর্তিত হবে বলে আমার ধারণা। যে পথেই যাকনা কেন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উপযুক্ত ব্যবহারে সক্ষম দক্ষ শ্রমসম্পদ গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরী।
বিবর্তনের আলোচনা থেকে কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয় উঠে এসেছে, যা উল্লেখ করে এ’নিবন্ধের ইতি টানবো। শ্রমসেবায় ন্যূনতম মান প্রতিষ্ঠা না করা গেলে এবং বিধির আওতাধীন সংস্থা’রমাধ্যমে শ্রম-যোগান নিশ্চিত করা না গেলে অনিশ্চয়তা ও চুক্তি ভঙ্গের কারনে খরচ বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকবে। এ’ব্যাপারে তিনটি নির্দিষ্ট কর্মগোষ্ঠী’র উল্লেখ করেছি – ডেভেলপার, ইন্টেরিয়র, এবং নানা জাতের আবাসন সামগ্রী’র সরবরাহকারী। নীতি-পর্যায়ে এদেরকে উপযুক্ত বিধি-ব্যবস্থার আওতায় আনা আবশ্যিক। দ্বিতীয়, স্বাদের বিচিত্রতার কারনে সমধর্মী চাহিদা মেটানোর জন্য যখন বহুজাতের সামগ্রীর সমাহারঘটে, তাকে সনাতনী অর্থনীতিতে ‘ভোক্তা-সার্বভৌমত্ত্বে’র প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু নানান মোড়কে ভোগ্যপণ্যের সমাহার ঘটলে, সীমিত জ্ঞানের ভোক্তাদের ঠকানো সহজ হয়। এবং এক্ষেত্রে ‘ঠকে (ঠেকে) শেখা’র ইতিহাস আশাব্যঞ্জক নয়। বাজারে এজাতীয় ‘প্রতিযোগিতা’ বিনিময়ে মধ্যস্থতাকারী সংস্থা বা ব্যাক্তি’র অযাচিত লাভের সুযোগ করে দেয়, এবং বিনিময়ে বিশ্বাস-ঘাটতির কারনে বাজার-ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে। আরও লক্ষণীয় যে, সমধর্মী চাহিদামেটাতে সীমিত সংখ্যক না হয়ে বহুসংখ্যক সামগ্রী থাকলে সামগ্রী-ভিত্তিক বাজারের আকারক্ষুদ্র হয়, যা উৎপাদন সম্ভাবনার উপর ঋণাত্মক প্রভাব রাখে। স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন- এর মাধ্যমে মান নিয়ন্ত্রণ যেমন সম্ভব, তেমনি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের অর্থনীতিতে প্রকৃত বাজারের আকার বৃদ্ধি করা সম্ভব। এবং সেজাতীয় উদ্যোগ উৎপাদন-উদ্দেশ্যে দেশে বিনিয়োগ-সম্ভাবনা বৃদ্ধি করবে। অবাধ আমদানী নীতি ও আমদানী করা পণ্যের মানের উপর যৌক্তিক বিধি না থাকায় ভোক্তা-বিভ্রান্তি যেমন বেড়েছে, তেমনি আপাতদৃষ্টিতে ভোগ্যপণ্যের বিশাল বাজার থাকা সত্বেও তাকে বিনিয়োগ সম্ভাবনায় রুপান্তর ঘটাতে আমরা বহুলাংশে ব্যর্থ হয়েছি। পরিতাপের বিষয় এই যে, শেষ বিষয়টি বহুদিন নীতি-বিশ্লেষকদের দৃষ্টির আড়ালে রয়ে গেছে।
সাজ্জাদ জহির।
লেখক বর্তমানে ইকনোমিক রিসার্চ গ্রুপ-এর নির্বাহী পরিচালক
1195